অথবা, প্রাচীন এবং মুঘল ভারতের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের প্রকৃতি আলোচনা কর।
অথবা, প্রাচীন ও মুঘল ভারতের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের প্রকৃতি বর্ণনা কর।
অথবা, প্রাচীন ও মুঘল ভারতের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের প্রকৃতি সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, প্রাক ব্রিটিশ যুগে বাংলাদেশের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার ব্যবস্থার স্বরূপ বর্ণনা কর।
অথবা, প্রাক ব্রিটিশ যুগে বাংলাদেশের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার ব্যবস্থার স্বরূপ ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার স্থানীয় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত স্বাধীন শাসনব্যবস্থা। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের মাধ্যমে জনগণ তাদের দাবি-দাওয়াগুলো তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে সহজেই তুলে ধরতে পারে। সাথে সাথে স্থানীয় প্রতিনিধিরা ও জনগণের সাথে সহসা মিশে তাদের সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করতে পারে । ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন প্রভৃতি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান।
প্রাচীন ও মুঘল ভারতে/প্রাক ব্রিটিশ যুগে বাংলাদেশের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার
ব্যবস্থার স্বরূপ প্রকৃতি : বাংলাদেশে বর্তমানে যে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার ব্যবস্থার স্বরূপ দেখতে পাই ত একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিভিন্ন ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে তা আজকের রূপ ধারণ করেছে। ইংরেজ শাসনের পূর্বে ও বাংলাদেশের গ্রাম এলাকায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের অস্তিত্ব ছিল। গ্রামের জনগণ একত্রে মিলিত হয়ে তাদের সমস্যা
সমাধানের চেষ্টা করতেন। বিচার, আচার, সালিশ, শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা ও সমাজ সেবামূলক কাজগুলো তারা একত্রে বসে
সমাধান করতেন। কৌটিল্যের অর্থশান্ত্রে ও বাংলাদেশের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের উল্লেখ রয়েছে। শাসনব্যবস্থার সুবিধার জন্য সেন আমলে, পাল আমলে এবং সুলতানি শাসনামলেও এ অঞ্চলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হতো। তবে শুধুমাত্র সুষ্ঠুভাবে রাজস্ব আদায় করাই ছিল এ ধরনের বিভক্তির মূল লক্ষ্য। এ কারণে গ্রামের জনসাধারণ মিলিতভাবে তাদের সকল সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করতেন। বিশেষত গ্রামের অভিজাত পরিবারের সদস্যগণ একত্রিত হয়ে গ্রামের
শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করতেন এবং বিভিন্ন প্রকার সমাজকল্যাণমূলক কাজের উদ্যোগ নিতেন। এ অর্থে গ্রামগুলো ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং স্বায়ত্তশাসিত । শাসনব্যবস্থার দিক লক্ষ্য রেখেই ঐতিহাসিক চালর্স মেটকাফ (Charles Metcalf) বাংলার গ্রামগুলোকে ‘ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্র’ (Little Republic) বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রাচীন ভারতে গণতন্ত্রের বীজ নিহিত ছিল। গ্রাম পরিষদ গঠিত হত প্রাপ্ত বয়স্কদের নিয়ে অথবা গ্রামের সমস্ত বাড়ির
কর্তাদের নিয়ে। এছাড়া জেলে, কুমার, কামার, মুচিসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি গ্রাম্য সভায় থাকত। এই গ্রাম্য পরিষদ ছিল গ্রামের প্রশাসনিক এবং বিচার বিভাগীয় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। গ্রাম্য নির্বাহীদেরকে, গ্রাম্য পঞ্চায়েত নির্বাচন করতো যাদেরকে পঞ্চায়েত বলা হতো। এই স্থানীয় প্রশাসনের উপর কেন্দ্রীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ ছিল সামান্য। রাজার প্রতিনিধিরা গ্রামের বাইরে বাস করতেন। প্রাচীন ভারতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার বর্তমান সময়ের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত
সরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতা ভোগ করতো।
১২০০ খ্রিস্টপূর্বেও এই উপমহাদেশে গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন ছিল বলে জানা যায়। গ্রামগুলোর উপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ছিল না বললেই চলে । গ্রামের সম্পদ আহরণ করে উন্নয়নমূলক ও জনহিতকর কাজ সম্পাদন করা হতো। ধনীকৃষক বা উঁচু বর্ণেরাই গ্রাম প্রধান হতেন। তাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল গ্রামের বাইরে ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং কর আদায় করা। গ্রাম সভার প্রধান কাজ ছিল সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও বিরোধ মীমাংসা
করা। এছাড়া গ্রামের সম্পদ সংগ্রহ করে রাস্তাঘাট, পুল, কুয়া ইত্যাদি তৈরি এবং কল্যাণমূলক কাজ সম্পাদন করা হতো।
গ্রামের ভূমি, নদী, বনাঞ্চল, খাল, বিল ইত্যাদি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাও পঞ্চায়েতের দায়িত্ব ছিল। তার মানে অর্থসংক্রান্ত, প্রশাসনিক ও বিচার সংক্রান্ত সকল বিষয় পরিচালনা করার ক্ষেত্রে গ্রাম প্রধান ও পঞ্চায়েত ছিল স্বাধীন ।
মুঘলরা গ্রাম সরকারের প্রাচীন উপর খুব বেশি হস্তক্ষেপ করেনি। মুঘল শাসকগণ ছিলেন শহরকেন্দ্রিক তারা প্রশাসনের সুবিধার জন্য সমগ্র শাসনব্যবস্থাকে সুবা, সরকার, পরগনা এবং মহালে বিভক্ত করেন। বর্তমানে এগুলো প্রদেশ, জেলা, থানা উপজেলা এবং ইউনিয়নের সাথে তুলনীয়। মুঘলরা শুধুমাত্র গ্রামকে রাজস্ব সংগ্রহ এবং পুলিশ প্রশাসনের জন্য প্রশাসনের সাথে একত্র করেছে। মুঘল আমলে শাসকরা তাদের অনুগত নাগরিকদের গ্রামে রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়ে জমিদার শ্রেণি সৃষ্টি করেছিল। এই জমিদারগণ সাধারণ জনগণের উপর রাজস্ব সংগ্রহের নামে প্রায়ই শোষণ করতো। যদিও জনকল্যাণমূলক অনেক কাজ অনেক জমিদার করে গেছেন। কাজেই বলা যায় তখনকার গ্রাম সরকার, পঞ্চায়েত গৌরবময় ভূমিকা পালন করতো। তার গ্রামের শিক্ষার ব্যবস্থা করতো, গরিবদের সাহায্য করতো। গ্রামের রাস্তাঘাট নির্মাণ
করতো, পুকুর খনন করতো, সেচের ব্যবস্থা করতো। তাদের প্রতি সাধারণ জনগণের বিশ্বাস ছিল। গ্রামগুলো প্রতিরক্ষা ছাড়া কেন্দ্রের মুখোমুখি হতো না। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গ্রামে একটা সম্প্রদায়গত অনুভূতির উন্নয়ন করে যার দ্বারা তারা মারামারি হানাহানি ভুলে সুন্দরভাবে প্রশাসন চালাতে সাহায্য করতো।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রাক ব্রিটিশ বা ঔপনিবেশিক আমলের পূর্বে দীর্ঘসময় বাংলাদেশে শক্তিশালী স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন বিরাজ করেছিল। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার ব্যবস্থার ঐতিহ্য আমাদের দেশে একটি প্রাচীন সংগঠন । দীর্ঘ বিবর্তন প্রক্রিয়ায় এই ব্যবস্থা বর্তমান রূপ পরিগ্রহ লাভ করেছে।