স্থানীয় সরকার অধ্যয়নের পদ্ধতিসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, স্থানীয় সরকার অধ্যয়নের পদ্ধতিসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, স্থানীয় সরকার অধ্যয়নে পদ্ধতিসমূহ আলোকপাত কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ধারণা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ধারণাটি একটি পুরাতন ধারণা। প্রাচীন ভারতে গ্রামে পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে ব্রিটিশ ভারত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটে। পাকিস্তান শাসনামলের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বিভিন্ন আঙ্গিকে আত্মপ্রকাশ করে। কাজেই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও গণতন্ত্রের বিকাশে স্থানীয় সরকার অধ্যয়ন আবশ্যক।
স্থানীয় সরকার অধ্যয়ন পদ্ধতিসমূহ : গতানুগতিক পদ্ধতি বলতে পুরাতন পদ্ধতিকে বুঝায়। নিম্নে পদ্ধতিগুলো আলোচনা করা হলো :
১. অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতি বা পরীক্ষামূলক পদ্ধতি : স্থানীয় সরকার অধ্যয়ন পদ্ধতির অন্যতম প্রধান জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতি। স্থানীয় সরকার অধ্যয়নে এ পদ্ধতির ব্যবহার ব্যাপক। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রশাসনিক কাঠামো, এবং স্থানীয় সংস্থাকে একটি পরীক্ষাগার বলে মনে করা যেতে পারে। এখানে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংস্কারসহ বিভিন্ন আইনের নীতিমালা প্রবর্তন করার মানসে নতুন নতুন কৌশল বাস্ত বায়নের কাজ গৃহীত হয়। অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতি স্থানীয় সরকারকে একটি বাস্তবরূপ ও প্রাকৃতিক রূপ হিসাবে গণ্য করেও বুঝতে চায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় কোন আইন প্রয়োজন। এ আইনের দ্বারা জনগণ কতটুকু উপকৃত হবে স্থানীয় পর্যায়ে আইনের বাস্তবতা ও উপযোগিতা এ পদ্ধতির মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়।
২. ঐতিহাসিক পদ্ধতি : স্থানীয় সরকার অধ্যয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হলো ঐতিহাসিক পদ্ধতি । ঐতিহাসিক পদ্ধতি স্থানীয় সরকার অধ্যয়নে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। সাম্প্রতিককালে স্থানীয় সরকার অধ্যয়নে এ পদ্ধতির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় উৎপত্তি, বিকাশ ও অগ্রগতির ইতিহাস জানার জন্য এ পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার জন্ম তার ক্রমবিকাশ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত ঐতিহাসিক
পদ্ধতির মাধ্যমে জানা যায়। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ ও সমাধানের জন্য ঐতিহাসিক পদ্ধতির গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়। ঐতিহাসিক পদ্ধতি স্থানীয় মানুষের জীবন ও ঘটনাবলিকে ধারণ করে স্থানীয় সরকার অধ্যয়ন করে থাকে ফলে তা বাস্তবপদ্ধতি পরিগণিত হয়।
৩. তুলনামূলক পদ্ধতি : স্থানীয় সরকার অধ্যয়নে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হলো তুলনামূলক অধ্যয়ন পদ্ধতি। তুলনামূলক অধ্যয়ন পদ্ধতিকে, ঐতিহাসিক পদ্ধতির পরিপূরক বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক ঘটনাবলি, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, ক্ষমতার বণ্টন প্রভৃতি ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে তুলনামূলক পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়। তুলনামূলক পদ্ধতিতে অধ্যয়নের ফলে কতকগুলো সাধারণ সূত্রে উপনীত হওয়া যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল তুলনামূলক পদ্ধতিতে রাজনীতি অধ্যয়ন করতেন। তিনি গবেষণায় তুলনামূলক
পদ্ধতির ব্যবহার করেন। উন্নয়নশীল দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার স্বরূপ ও প্রকৃতি বাস্তব সমীক্ষা উপস্থাপনে তুলনামূলক
পদ্ধতি একটি কার্যকরী পদ্ধতি।
৪. পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতি : অধ্যয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতির অপর নাম আরোহণ পদ্ধতি। দার্শনিক প্লেটোর যুগ থেকে এ পদ্ধতির ব্যবহার চলে আসছে। এ পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে খুব সহজে স্থানীয় সরকার কাঠামোর মূলে পৌঁছানো যায়।
৫. দার্শনিক পদ্ধতি : স্থানীয় সরকার অধ্যয়ন পদ্ধতির মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন পদ্ধতি হলো দার্শনিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার কতকগুলো বিষয়কে পূর্ব অনুমানের ভিত্তিতে স্তরসিদ্ধ বলে নেয়া হয় এবং অবরোহ
পদ্ধতিতে সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। এ পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকারের প্রকৃতি, স্থানীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা, ব্যক্তির সাথে স্থানীয় সরকারের সম্পর্ক। কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে স্থানীয় সরকারের সম্পর্ক ইত্যাদি বহুবিধ প্রশ্নের উত্তর সমাধান করা হয়।
৬. প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি : স্থানীয় সরকার অধ্যয়নের অন্যতম গতানুগতিক পদ্ধতি হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি। প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি বলতে স্থানীয় অধ্যয়নের এমন এক দৃষ্টিভঙ্গিকে বুঝায় যা স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠান অধ্যয়নের মাধ্যমে রাজনীতিকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রচেষ্টা চালায়। এ পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ও প্রকৃতি পরীক্ষানিরীক্ষা করা যায়।
৭. আচরণগত পদ্ধতি : স্থানীয় সরকার অধ্যয়নে আচরণগত বা মনোবিজ্ঞান পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আচরণগত পদ্ধতির বিশ্লেষণের মূল একক হলো ব্যক্তি। এ পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নিয়োজিত ব্যক্তির কার্যকলাপ, অনুভূতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা ও পছন্দ প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়ে থাকে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ ও তাদের সত্যাসত্য যাচাইয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সুসমন্বিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ অনুসন্ধানই হলো আচরণবাদ। স্থানীয় পর্যায়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর রাজনৈতিক আচরণকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ব্যাখ্যা করা
হয়। মূলত এ পদ্ধতিতে ব্যক্তির কার্যকলাপ, অনুভূতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয় স্থানীয় সংগঠনের মানবিক কার্যক্রমে আলোচনাসহ আচরণগত পদ্ধতির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ।
৮. কাঠামো কার্যগত পদ্ধতি : স্থানীয় সরকার অধ্যয়নে কাঠামো কার্যগত পদ্ধতি একটি আধুনিক ও কার্যকরী পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে স্থানীয় একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কি কার্য কোন কাঠামো দ্বারা সম্পাদিত হয় তার ভিত্তিতে স্থানীয় রাজনীতি ব্যাখ্যা করে এবং তুলনামূলক অধ্যয়ন করার চেষ্টা করে। বর্তমানে স্থানীয় রাজনীতি অধ্যয়নে এ পদ্ধতি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কাঠামো কার্যগত পদ্ধতির প্রবক্তা হলেন জি. এ. অ্যালমন্ড। কাঠামো ও কার্যের ভিত্তিতে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা অধ্যয়ন করে।
৯. পরিসংখ্যানিক অধ্যয়ন পদ্ধতি : স্থানীয় সরকার অধ্যয়ন পদ্ধতিগুলোর মধ্যে পরিসংখ্যানিক অধ্যয়ন পদ্ধতি একটি আধুনিক পদ্ধতি । স্থানীয় সরকার স্থানীয় জনগণের উপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে। জনগণের উপর পরিচালিত তথ্য উপাত্ত থেকে স্থানীয় সরকার এ পদ্ধতির মাধ্যমে খুব সহজে জীবনযাত্রার মান, সাক্ষরতার হার, দরিদ্রতা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, উৎপাদন, ভাগ, বণ্টন, আমদানি ও রপ্তানি সম্পর্কে জানা যায়। ফলে স্থানীয় সরকার তার প্রয়োজনমতো এবং চাহিদা মাফিক কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন করতে পারে।
১০. মনস্তাত্বিক অধ্যয়ন পদ্ধতি : বর্তমান সময়ে স্থানীয় সরকার অধ্যয়নে মাস্তাত্ত্বিক অধ্যয়ন পদ্ধতি একটি অন্যতম আধুনিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতির মাধ্যমে সরকার ব্যবস্থার স্থানীয় জনগণের মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে। স্থানীয় পর্যায়ে জনমত, স্থানীয়, আদর্শ, স্থানীয় জাতীয়তা, স্থানীয় রাজনৈতিক মূল্যবোধ বিচারবিশ্লেষণ করে থাকে ।
১১. সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি : স্থানীয় সরকার ও রাজনীতি অধ্যয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। যে কোন ধরনের সরকার ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। রাজনীতি বিশ্লেষণে এ পদ্ধতি অধিক মাত্রায় প্রয়োগ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যতীত কোন কাজ সম্পন্ন হয় না।
১২. বর্ণনামূলক পদ্ধতি : স্থানীয় সরকার অধ্যয়ন পদ্ধতির মধ্যে বর্ণনামূলক পদ্ধতি একটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নির্দিষ্ট কোন অংশের বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। এ পদ্ধতিতে স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, স্থানীয় সরকার অধ্যয়ন পদ্ধতি বর্তমান সময়ে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। স্থানীয় সরকার অধ্যয়নে বিভিন্ন গতানুগতিক পদ্ধতি লক্ষ করা যায়। স্থানীয় সরকার অধ্যয়নে ও বিশ্লেষণে উপরিউক্ত পদ্ধতিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। স্থানীয় সরকার দেশের সার্বিক উন্নয়নকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে থাকে।