আইন ও সালিশি কেন্দ্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আলোচনা কর।

অথবা, আইন ও সালিশি কেন্দ্রের কার্যক্রম ও প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা কর
অথবা, আইন ও সালিশি কেন্দ্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, আইন ও সালিশি কেন্দ্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, আইন ও সালিশি কেন্দ্রের কার্যক্রম ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : অধিকার হরণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু বাস্তবতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরেও এ দেশের জনগণের মানবাধিকার সংরক্ষণ করা হয়ে উঠে নি। ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা এখানে দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণের মানবাধিকার রক্ষায় অসংখ্য মানবাধিকার সংগঠন গড়ে উঠে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে। আইন ও সালিশি কেন্দ্র তেমনি একটি মানবাধিকার বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যা এদেশের অধিকার বঞ্চিত জনগণকে অধিকার পুনরুদ্ধারে নানাভাবে সাহায্য করে থাকে। বাংলাদেশের জনগণের মানবাধিকারের দাবিকে বাস্তবায়ন করতে আইন ও সালিশি কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করে চলছে।
আইন ও সালিশি কেন্দ্রের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : আইন ও সালিশি কেন্দ্র বাংলাদেশের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যা মানবাধিকার সংরক্ষণে জনগণকে সহায়তা করে থাকে। স্বাধীনতার পরবর্তীতে দীর্ঘদিনের আর্থসামাজিক অবস্থার অবক্ষয়ের ফলে
সমাজে নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যা এদেশের জনগণের সামান্যতম মানবাধিকারকেও ভূলুণ্ঠিত করে। আর এ অবস্থা পর্যালোচনা করে এদেশের সচেতন একটি আইনজীবী দল, সমাজকর্মী, সাংবাদিক এবং উন্নয়নকর্মী মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। আর এরই আলোকে ১৯৮৬ সালে আইন ও সালিশি কেন্দ্র গড়ে উঠে তাদের যৌথ উদ্যোগে । জন্মলগ্ন থেকে মানবাধিকার রক্ষায় এ প্রতিষ্ঠান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
আইন ও সালিশি কেন্দ্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : ১৯৮৬ সালে মানবাধিকার রক্ষায় সময়ের দাবি মিটাতে কতিপয় মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কিছুসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবী সমাজসেবকের ব্যক্তিগত উদ্যোগেই আইন ও সালিশি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই উক্ত প্রতিষ্ঠানটি এদেশের জনগণের মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য সবরকম সাহায্য ও সহযোগিতা করে যাচ্ছে। যে মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আইন ও সালিশি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা
করা হয়েছে নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :
১. লিঙ্গ সচেতনতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার নীতির উন্নয়ন : বাংলাদেশের সমাজজীবন অজ্ঞতা, নিরক্ষরতা, কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ। ফলে এদেশের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লিঙ্গ বৈষম্য, সামাজিক অবিচার ও
মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রবেশ করে সমাজজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। ফলে সমাজের শতকরা ৯০ জন মানুষ তাদের ন্যায্য
মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে সামাজিক অবিচারের শিকার হয়। তাছাড়া ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অপব্যাখ্যা, কুসংস্কার ও পশ্চাৎপদতার কারণে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করে নারী পুরুষ সমতা সমাজে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়ে উঠে নি। আর এ রকম পরিস্থিতিতে এদেশের জনজীবনে সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন এবং জেন্ডার সচেতনতা আনয়ন ও উন্নয়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে আইন ও সালিশি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশের বৃহৎ সামাজিক পরিমণ্ডলের আলোকে আইন ও সালিশি কেন্দ্রের ভূমিকা পালন হয়ত দেশের বেশিরভাগ মানুষের কল্যাণে আসবে না, কিন্তু এর এ লক্ষ্যার্জন সফল হলে সমাজের একটি মুষ্টিমেয় অংশ হলেও উপকৃত হবে তাতে সন্দেহ থাকার কথা নয়।
২. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পরিবেশ সৃষ্টি : স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘদিন পরও বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের সমাজজীবনে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়ে উঠে নি। ফলে সমাজজীবন থেকে সামাজিক অনাচার, অবিচার ও বৈষম্য দূর করা সম্ভব হয়ে উঠে নি। ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘন এদেশের সমাজজীবনে নিত্যদিনের
ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। উপরন্তু এদেশের জনগণের অজ্ঞতা ও নীরবতার জন্য তারা দেশের প্রচলিত আইনকানুন ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারে নি। ফলে তারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেও হৃত অধিকার
পুনরুদ্ধারের জন্য যথাযথ Legal Aid লাভ করতে পারে না, যা এদেশের সমাজজীবনে মানবাধিকার রক্ষার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। আর এ অবস্থা পর্যালোচনা করেই এদেশের জনগণকে আইনি সহায়তা প্রদান, পরামর্শ ও সচেতনতা আনয়নের মাধ্যমে আইনের শাসনের সমাজ প্রতিষ্ঠা করাকে একটি লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইন ও সালিশি কেন্দ্র। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে আইনি পরিবেশ গড়ে তোলা আইন ও সালিশি কেন্দ্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
৩. জাতি, লিঙ্গ, শ্রেণি, বর্ণ, সম্প্রদায়গত বৈষম্য রোধ এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা : স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর থেকে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু শ্রেণি, দুর্বল সম্প্রদায় ও গোত্র তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এমনকি সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত দেশের প্রতিটি নাগরিকের ভোট প্রয়োগের অধিকার থেকেও তারা নানা রকম
অপশক্তির চাপে বঞ্চিত হয়, লাঞ্ছিত হয় তাদের মানবাধিকার। তাছাড়া সমাজজীবনের প্রচলিত নানারকম কুপ্রথা ও বিশ্বাস এবং জেন্ডার বৈষম্যও এ অধিকার হরণের জন্য দায়ী। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ আইন ও সালিশি কেন্দ্র দেশের জনগণের মানবাধিকার রক্ষার জন্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র বৈষম্য বিলোপ করে সামাজিক কুপ্রথা বিশ্বাস ও জেন্ডার বৈষম্য বিলোপ করে সকলের অধিকার বাস্তবায়ন করে থাকে, যা এর একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
উপসংহার : উপর্যুক্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আইন ও সালিশি কেন্দ্র পথ চলে। আর আইন ও সালিশি কেন্দ্র দখ
যদি তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে পুরোপুরি সক্ষম হয়, তাহলে একথা জোর দিয়েই বলা যায় যে, বাংলাদেশের অধিকার বঞ্চিত
জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধারে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। যদিও দেশের পরিমণ্ডলে এর কার্যক্রমের
পরিধি খুবই সীমিত, তবুও অত্যন্ত যুক্তিসংগতভাবেই বলা যায় যে, আইন ও সালিশি কেন্দ্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য খুবই যুগোপযোগী।