অথবা, ইয়ং বেঙ্গল কারা? বাংলাদেশ দর্শনে ইয়ং বেঙ্গলদের অবদান বর্ণনা কর।
অথবা, ইয়ং বেঙ্গল কাদের বলা হয়? বাংলাদেশ দর্শনে ইয়ং বেঙ্গলদের কী কী ভূমিকা ছিল? ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ইয়ং বেঙ্গল কারা? বাংলাদেশ দর্শনে ইয়ং বেঙ্গলদের কী কী অবদান রয়েছে? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত অঞ্চলে যে নবজাগরণের সূচনা হয় তারই একটি সাংগঠনিক ও সামগ্রিক প্রয়াস হলো ইয়ং বেঙ্গল। এ সংগঠন বা আন্দোলনের সূচনাকারী ছিল কলকাতা হিন্দু কলেজের কয়েকজন প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তার ধারক ও বাহক ছাত্র-শিক্ষক। এ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য
হলো সমাজে প্রচলিত ভাবাদর্শের যুক্তিবাদী সংস্কার, সমাজকে অন্ধকার, কুসংস্কার ও সামাজিক অন্যায় অবিচার হতে মুক্ত করা।
ইয়ং বেঙ্গলদের পরিচয় : রাজা রামমোহনের পরে উদারপন্থি ভাবধারার বিকাশে যাঁদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁরা সাধারণত ইয়ং বেঙ্গল নামে পরিচিত। এ গোষ্ঠীর দীক্ষাগুরু ছিলেন কলকাতা হিন্দু কলেজের অ্যাংলো-
ইন্ডিয়ান শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১)। ডিরোজিও পন্থিদের মতে, রামমোহনের সংস্কার আন্দোলন আংশিক সফল হলেও তা ঈস্পিত পরিণতি লাভ করতে পারেনি। তাঁরা বিশেষত সমালোচনামুখর হয়ে উঠেন আধ্যাত্মিকতা ও
মরমীবাদের প্রতি এবং অনুরাগী হলেন বস্তুবাদী ভাবধারা ও প্রগতিশীল জীবনদর্শনের। ডিরোজিও ছাড়াও ইয়ং বেঙ্গল
সংগঠনের অন্যতম চিন্তানায়ক ছিলেন ডেভিড হেয়ার। খ্রিস্টান মিশনারীরা সেকালে ছাত্রসমাজকে প্রভাবিত করার যে উদ্যোগ
গ্রহণ করেছিল তার গ্রাস থেকে হিন্দু কলেজের ছাত্রদেরকে রক্ষা করার, সে সঙ্গে প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস, অনাচার ও অবক্ষয়
থেকে ছাত্রদের রক্ষা করার এবং সন্ধিৎসু মন ও উন্নত চিন্তা গড়ে তোলার কাজে তিনি জীবনপাত করেছিলেন। সুতরাং বলা যায়, হিন্দু কলেজের শিক্ষক ডিরোজিও’র অনুসারী যে কয়েকজন যুক্তিবাদী শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের
সম্মিলিত প্রয়াসে বাংলায় যে সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় তাঁরাই ইতিহাসের পাতায় ইয়ং বেঙ্গল নামে পরিচিত।
বাংলাদেশ দর্শনে ইয়ং বেঙ্গলদের অবদান : বাংলাদেশ দর্শনের সমৃদ্ধিতে যে কয়টি দার্শনিক আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল ইয়ং বেঙ্গলদের দার্শনিক আন্দোলন। ইয়ং বেঙ্গল দার্শনিক আন্দোলনের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন কলকাতা হিন্দু কলেজের তরুণ শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। ডিরোজিও
কলকাতা হিন্দু কলেজের শিক্ষক হয়ে সমাজের বিভিন্ন দিকে দৃষ্টি দিলেন এবং প্রয়োজন অনুভব করলেন সংস্কারের। আর
এ প্রয়োজনের তাগিদেই তিনি একত্রিত করলেন হিন্দু কলেজের কিছু প্রগতিশীল যুক্তিবাদী শিক্ষার্থী ও শিক্ষকে। এসব ছাত্র
ও শিক্ষক একত্র হয়ে শুরু করলেন সমাজসংস্কার এবং প্রচার করতে লাগলেন তাঁদের নিজস্ব দার্শনিক’ মত। নিম্নে
বাংলাদেশ দর্শনে ইয়ং বেঙ্গলদের ভূমিকা বর্ণনা করা হলো :
ভীষ্ট যুক্তিবাদিতা : ইয়ং বেঙ্গলদের দার্শনিক মতের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য যুক্তিবাদিতা। ইয়ং বেঙ্গল দার্শনিকরা যুক্তির কষ্টিপাথরে সবকিছুই যাচাই করার চেষ্টা করেন। প্রাচ্য সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের অনীহা ছিল এ কারণে যে, এখানকার সংস্কৃতি বলতে যা বুঝানো হয় তা আসলে আবেগের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁদের দার্শনিক আদর্শ ছিল ‘সত্যের জন্য বাঁচা ও সত্যের জন্য মরা।’ অর্থাৎ তাঁদের মতে, যুক্তির কষ্টিপাথরে যা ভালো বলে প্রতীয়মান হবে এবং যা প্রগতিশীল চিন্তাধারার সহায়ক তাই সত্য; আর এ সত্যের জন্য জীবনও উৎসর্গ করা যায়। তাঁরা অদৃষ্টবাদ, ব্যক্তিস্বাধীনতা, স্ত্রী শিক্ষা, নারী স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়ে স্বাধীন যুক্তিবুদ্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত সবধরনের সংস্কারমুক্ত মতামত প্রকাশ করতেন এবং ছাত্রদেরকে এসব বিষয়ে স্বাধীনভাবে ও নির্ভীক উপায়ে চিন্তা করতে উৎসাহ দিতেন। আর তাঁদের এ যুক্তিবাদী চিন্তাধারা বাংলাদেশ দর্শনের দার্শনিকদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
কুসংস্কারমুক্ত চিন্তা : ইয়ং বেঙ্গল দার্শনিকরা সবধরনের কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে মুক্ত মনে দর্শনচিন্তা করেছেন এবং তৎকালীন বাঙালি জনগণকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার মহান ব্রত গ্রহণ করেন। ইয়ং বেঙ্গলেরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন না থেকে প্রগতিশীল চিন্তাধারার নতুন অধ্যায় সূচনা করেন। তাঁরা বস্তুবাদী দর্শন প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন। বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি তাঁদের গভীর আগ্রহের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। ইয়ং বেঙ্গল দার্শনিকরা ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ঐ সময় ডিরোজিও’র শিষ্য হেয়ার স্কুলের শিক্ষক দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন, “পরকাল নাই এবং মনুষ্য ঘটিকা যন্ত্রের ন্যায়।” তাঁদের এরকম মনোভাবের কারণে অনেক প্রতিকূলতাও সহ্য করতে হয়েছে। কিছু রক্ষণশীল ব্যক্তি তাঁদেরকে বিতাড়িত
করতে সচেষ্ট হয়েছিল কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। হিন্দু কলেজের শিক্ষক থাকাকালীন ডিরোজিও’র উদ্যোগে একাডেমিক এসোসিয়েশন (Academic Association) প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে কুসংস্কারমুক্ত মনে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা
হতো। এভাবে ইয়ং বেঙ্গলরা বাংলাদেশ দর্শনে তাঁদের কুসংস্কারমুক্ত চিন্তাধারার সূচনাকল্পে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
প্রগতিশীল চিন্তাধারা : ইয়ং বেঙ্গল দার্শনিক আন্দোলনের দার্শনিকরা প্রগতিশীল চিন্তাধারায় উদ্ভাসিত ব্যক্তির মূর্ত দৃষ্টান্ত। ইয়ং বেঙ্গলদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একাডেমিক এসোসিয়েশন (Academic Association) এর চিন্তার মূল বিষয় ছিল চারপাশের সমাজ ও জীবন। তাঁদের দার্শনিক উক্তি,“সবকিছুর প্রতি সন্দিহান হও, অনুসন্ধান করে সংশয় নিরসন কর, তথ্য পর্যবেক্ষণ করে সত্য নির্ণয়ে তৎপর হও, নির্ণীত সত্য যখন বাস্তবের পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তিত অবস্থায় কার্যকর
থাকে না তখন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত সত্য সম্পর্কে সন্দিহান হও এবং এভাবে সংশয় অনুসন্ধানকর্ম অন্তহীন ধারায় চালিয়ে
যাও।” তাঁদের এ উক্তি প্রমাণ করে যে তাঁরা অত্যন্ত প্রগতিশীল চিন্তাধারার ধারক ও বাহক ছিলেন।
সংশয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি : ইয়ং বেঙ্গল দার্শনিক সম্প্রদায় ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের ঈশ্বরের সন্ধান পেলেই তাঁর অস্তিত্ব স্বীকার করা হবে, অন্যথায় না পাওয়া পর্যন্ত কিছুই বিশ্বাস করা উচিত হবে না। তাঁরা ডেভিড হিউমের দর্শনের অনুরাগী পাঠক ছিলেন। ডেভিড হিউম যেমন প্রত্যক্ষণজাত অভিজ্ঞতা ব্যতীত কোনকিছুর
অস্তিত্ব স্বীকার করতে রাজি নন, তেমনি ইয়ং বেঙ্গল দার্শনিকরাও প্রমাণ ব্যতীত কোনকিছু গ্রহণ করতে নারাজ তৎকালীন সময়ে বাঙালি সমাজে প্রচলিত যেসব কুসংস্কার ছিল তাঁরা সেগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখতেন এবং যুক্তির মাধ্যমে সেগুলোর যথার্থতা প্রমাণ করতে না পেরে সমাজ থেকে সেগুলো সরিয়ে ফেলার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। এ সন্দেহবাদী
দৃষ্টিভঙ্গি ইয়ং বেঙ্গলদের নাস্তিকতার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। পরবর্তীকালের বাংলাদেশ দর্শনে আমরা এরকম দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাই। এক্ষেত্রে দার্শনিক আরজ আলী মাতব্বরের নাম উল্লেখযোগ্য। সুতরাং বলা যায় যে, বাংলাদেশ দর্শনে ইয়ং বেঙ্গলদের সন্দেহবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল তার অগ্রপথিক ছিলেন ইয়ং বেঙ্গল দার্শনিকরা। তাদের যুক্তিবাদী, সংশয়বাদী, কুসংস্কারমুক্ত প্রগতিশীল চিন্তাধারা বাংলাদেশ দর্শনে
এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। তাই বলা যায়, বাংলাদেশ দর্শনে ইয়ং বেঙ্গলদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।