অথবা, বাংলাদেশ দর্শন কী? বাংলাদেশ দর্শনের উদ্ভব ও প্রকৃতি আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশ দর্শন বলতে কী বুঝ? বাংলাদেশ দর্শনের উৎপত্তি ও স্বরূপ আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশ দর্শনের সংজ্ঞা দাও। বাংলাদেশ দর্শনের উদ্ভব ও স্বরূপ আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব একটি দর্শন আছে। তেমনি বাঙালিজাতিরও নিজস্ব দর্শন রয়েছে। বাঙালি দর্শন মূলত বাংলাদেশ দর্শন। বাঙালি দর্শনের যে অংশ বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকে রচিত হয়েছে তাকেই যথার্থ অর্থে বাংলাদেশ দর্শনই বলা যায়। বাংলাদেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গের বিভিন্ন দার্শনিক সমস্যা সম্পর্কিত সুচিন্তিত মতবাদ নিয়ে বাংলাদেশ দর্শন গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ দর্শনে বস্তুবাদী বা অধ্যাত্মবাদী দর্শন চর্চা যেমন বিদ্যমান তেমনি এখানে রয়েছে এ দুটি ধারার মধ্যে সমন্বয়ের একটি প্রচেষ্টা। তবে বাংলাদেশ দর্শন মানেই বাংলাদেশে বসবাসরত বা বাঙালি জাতি সকল চিন্তাবিদদের একটি সমন্বিত প্রয়াস।
বাংলাদেশ দর্শন : আবহমানকাল ধরে বাংলার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের বৈচিত্র্যময় রূপ ও রসের মাধুর্যে আপ্লুত হয়ে মরমি চেতনা উদ্বুদ্ধ যে দর্শন জন্ম লাভ করেছে তাকেই বাংলাদেশ দর্শন নামে আখ্যায়িত করা হয়। অন্যভাবে বলা যায় যে, প্রজ্ঞাময় দর্শন বাংলাদেশের আবহমানকালের বিশাল পটভূমিতে অতীত হতে বর্তমান পর্যন্ত আবর্তিত হয়েছে তাই-ই
বাংলাদেশ দর্শন । বাংলাদেশ দর্শন হলো বাঙালির সংস্কৃতির দর্শন। লিসা বাংলাদেশ দর্শন সম্পর্কে ড. প্রদীপ কুমার রায় বলেছেন, “যে প্রজ্ঞাময় দর্শন বাংলাদেশের আবহমানকালের বিশাল পটভূমিতে প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে এ সময় পর্যন্ত বিবর্তিত হয়েছে তাই বাংলাদেশ দর্শন।”
অধ্যাপক মফিজ উদ্দীন আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশ দর্শন মোক্ষ বা মুক্তি লাভকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।” অধ্যাপক সাইদুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশ দর্শন কেবল সমদর্শন নয়, খালি পরলোক চর্চা নয়, তত্ত্ববিদ্যার নিছক
রোমন্থন ও কসরত নয়, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের যে কোনো সার্থক দর্শনের ন্যায় বাংলাদেশ দর্শন মূলত জীবনদর্শন। উন্নত মানবজীবন প্রণয়ন ও যাপনের উপায়ুনুসন্ধান।” সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, বাংলাদেশ দর্শন হলো বাঙালির শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনা, মনন ইত্যাদি সম্পর্কিত জীবনদর্শন।
বাংলাদেশ দর্শনের উৎপত্তি : বাংলাদেশ দর্শনের প্রথম ভিত্তি বা উৎস হিসেবে আমরা যে বিষয়গুলোকে পাই সেগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. প্রাক বৈদিক চিন্তাধারা : বাংলাদেশ দর্শনের প্রথম বীজ রোপণ হয় প্রাক-বৈদিক চিন্তাধারায়। প্রাচীন বাংলার অনার্য সম্প্রদায় এর ধারক ও বাহক, যাদের আমরা দ্রাবিড়-অস্ট্রিক বলে থাকি। এরা লোকায়ত বা চার্বাক নামে পরিচিত। তারা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণকে জ্ঞানের একমাত্র প্রমাণ বলে মনে করতো। বাঙালি দর্শন তথা বাংলাদেশ দর্শনের বস্তুবাদী ধারার সাথে তাদের সম্পর্ক রয়েছে।
২. বৈদিক চিন্তাধারা : বাংলায় আর্যদের আগমনের মাধ্যমে বৈদিক চিন্তাভাবনা অনুপ্রবেশ করে। বৈদিক চিন্তাধারায় অধ্যাত্মবাদ বা ভাববাদের বিকাশ লক্ষণীয়। বিভিন্ন পূজার্চণা ও ধর্মীয় ধ্যানধারণার আলোকে তাদের দর্শন বিকাশ লাভ করে। বাংলাদেশ দর্শনে বৈদিক চিন্তাধারার প্রভাব অনস্বীকার্য।
৩. বেদের বিরোধী চিন্তাধারা : বেদ বিরোধী চিন্তাধারা বলতে চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধ দর্শনকে বোঝায়। এ তিনটি সম্প্রদায় বেদের প্রামাণ্যকে অস্বীকার করে নিজস্ব দর্শন রচনা করে যা বাংলাদেশ দর্শনের বস্তুবাদী ও নাস্তিক্যবাদী চিন্তাধারার সাথে সম্পর্কিত। বাঙালি দর্শনের উৎস হিসেবে এ তিনটি ধারা বাংলাদেশ দর্শনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে
রয়েছে।
৪. ইসলামিক চিন্তাধারা : বাংলাদেশ দর্শনের উৎসভূমি হিসেবে ইসলামি চিন্তাধারার প্রভাব অনস্বীকার্য। ইসলামের সাম্যবাদ, মানবতাবাদ, বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ ও তত্ত্ব দর্শন দ্বারা বাংলাদেশ দর্শন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। তাছাড়া ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন ধর্মীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও বাংলাদেশ দর্শনে প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে। বিশেষ করে মুসলিম দার্শনিকদের ক্ষেত্রে এ
কথা শতভাগ সত্য।
৫. পাশ্চাত্য প্রভাব : বাংলাদেশ দর্শনের ক্রমবিকাশে পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারার প্রভাব অপরিসীম। প্রত্যক্ষবাদ, উপযোগবাদ এবং মাকর্সবাদ দ্বারা বিভিন্ন বাঙালি প্রভাবিত হয়ে দর্শন রচনা করেন।
৬. মরমিবাদ : বাংলাদেশ দর্শনের উৎস হিসেবে মরমি চিন্তাধারা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। বৈষ্ণববাদ, বাউলবাদ এবং সুফিবাদ ব্যতীত বাঙালি দর্শন বা বাংলাদেশ দর্শন চিন্তা করা অসম্ভব। এ মরমিবাদ বাঙালি দর্শনের অধ্যাত্মবাদী ধারাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। পুতরাং আমরা বলতে পারি যে, বাংলাদেশ দর্শনের উৎসভূমি হিসেবে বৈদিক, অবৈদিক, বেদবিরোধী, ইসলামি,
মরমি, পাশ্চাত্য প্রভৃতি চিন্তাধারাকে বোঝায়।
বাঙালি দর্শনের প্রকৃতি : অনার্যরাই বাংলাদেশে প্রথম দার্শনিক চিন্তার সূচনা করে। তারা বস্তুবাদী দর্শনতত্ত্ব প্রচার করে। তাদের দর্শনকে লোকায়ত বা চার্বাক দর্শন নামে অভিহিত করা হতো। বর্তমানে প্রচলিত জড়বাদী দর্শনে চার্বাকদের প্রভাব রয়েছে। চার্বাকরা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণকে জ্ঞানের একমাত্র উৎস বলে মনে করেন। অনার্যদের সময়ে জড়বাদের প্রসার ঘটলেও অধ্যাত্মবাদের প্রচলন ছিল। প্রাচীন বাঙালিদের এক অংশ অধ্যাত্মবাদের চর্চা করতো। সুতরাং আমরা দেখি যে, বাংলাদেশ দর্শনের জড়বাদী ও অধ্যাত্মবাদী ধারা প্রাচীন যুগ থেকেই ধারাবাহিকভাবে চলে এসেছে। তবে বাংলাদেশে ভাববাদের প্রকৃত বিকাশ ঘটে আর্যদের আগমনের পর। বাংলাদেশ দর্শনের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গেলে আমরা দেখি যে, বেদ ও উপনিষদকে কেন্দ্র করে প্রচলিত
জড়বাদের বিপরীতে অধ্যাত্মবাদ শক্তিশালী মতবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলাদেশ দর্শনে বৈদিক দর্শনের পাশাপাশি বেদবিরোধী জৈন ও বৌদ্ধ দর্শনের চর্চাও করা হতো। তবে বৌদ্ধ দর্শন বাংলাদেশ দর্শনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। অনেক শাসক বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করায় বৌদ্ধ জ্ঞান, বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চা ব্যাপক প্রসার লাভ করে। উপযুক্ত দর্শন ছাড়াও ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা প্রভৃতি দার্শনিক সম্প্রদায়ের চিন্তাধারা দ্বারা লি দর্শন প্রভাবিত। বাঙালি দর্শনে ইসলামি চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটে মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালেই। মুসলিম বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলামি সংস্কৃতি দ্বারা বাংলাদেশের চিন্তাবিদগণ প্রভাবিত হয়ে দর্শন রচনা শুরু করেন। স্থানীয়দের সাথে প্রাচ্যের মুসলমানদের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে বাঙালি দর্শন। ইসলামি চিন্তাধারার মধ্যে সুফিবাদ উপমহাদেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ষোড়শ শতাব্দীতে গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদের আবির্ভাব ঘটে। এরপর আসে বাউলবাদ। অনেকে সুফিবাদ ও বৈষ্ণববাদের সমন্বয়ে বাউলদের উদ্ভব বলে মনে করেন। বাউলবাদ বাঙালির নিজস্ব দর্শন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বাঙালি চিন্তাধারায় পাশ্চাত্যের উপযোগবাদ, প্রত্যক্ষবাদ এবং মানবতাবাদ প্রভাব ফেলে। আর এভাবেই গড়ে উঠে বাঙালি দর্শন বাংলাদেশ দর্শনের মূল ভিত্তি এবং বিকশিত হয় বাংলাদেশ দর্শন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ দর্শনে বিভিন্ন তাত্ত্বিক চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। পাশাপাশি অনুপ্রবেশকৃত ধ্যানধারণার সাথে সহনীয় ধ্যানধারণার সমন্বয়ে নতুন চিন্তাধারার বিকাশ ঘটেছে। আর তাই কঠোর বস্তুবাদী প্রাচীন বাঙালি দর্শনে অধ্যাত্মবাদ, মানবতাবাদ প্রভৃতির উদ্ভব ঘটেছে। বাংলাদেশ দর্শন শুরুতে জড়বাদী এবং বৈদিক যুগ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ধর্মভিত্তিক। কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনের প্রভাবে তা ক্রমশ সমন্বয়বাদী দর্শনে পরিণত হয়। বাঙালি দর্শন বা বাংলাদেশ দর্শনে দর্শনের সকল দিকই আলোচিত হয়েছে। বাংলাদেশ দর্শন যথার্থ দর্শন বলেই পরিচিত।