অথবা, বাংলাদেশ দর্শনের দার্শনিক ঐতিহ্যের ইতিহাস পর্যালোচনা কর।
অথবা,বাংলাদেশ দর্শনের ঐতিহ্যের ইতিহাস ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশ দর্শনের দার্শনিক ঐতিহ্যের ইতিহাস আলোচনা কর।
উত্তর৷ভূমিকা : বাংলাদেশ দর্শনের দার্শনিক ঐতিহ্যের একটি ঐতিহাসিক রূপরেখা প্রদান করা খুবই কঠিন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন উপাদানের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের জনসাধারণের দীর্ঘদিনের প্রচলিত রীতিনীতি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস-অবিশ্বাস প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ দর্শন বিকশিত হয়েছে। তাই এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশ দর্শন হলো বাংলাদেশের মানুষের ধ্যানধারণা, চিন্তা, মনন, ভাবধারা, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদির সংমিশ্রণ।
বাংলাদেশ দর্শনের দার্শনিক ঐহিত্য : পৃথিবীর অন্যান্য দর্শনের ন্যায় বাংলাদেশ দর্শনেরও একটি দার্শনিক ঐতিহ্য রয়েছে। বাংলাদেশ দর্শনের ঐতিহ্যে রয়েছে চর্যাপদ, বৈষ্ণববাদ, বাউলবাদ, বেঙ্গল রেনেসাঁ, উপযোগবাদ,
মানবতাবাদ ও মার্কসবাদের প্রভাব। আরো রয়েছে ইসলামি সুফিবাদ ও আধুনিক নিরীশ্বরবাদের বস্তুনিষ্ঠ চিন্তন। বাংলাদেশ
দর্শনের ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করলে তিনটি যুগ দৃশ্যমান হয়। (ক) প্রাচীন যুগ, (খ) মধ্য যুগ ও (গ) আধুনিক ও সমসাময়িক যুগ। এ তিনটি যুগের সমন্বিত ফলই হলো বাংলাদেশ দর্শন। নিচে বাংলাদেশ দর্শনের দার্শনিক ঐতিহ্য ব্যাখ্যা করা হলো।
১. বাংলাদেশ দর্শনের ঐতিহ্যে ভারতীয় দর্শনের প্রভাব : বাংলাদেশ দর্শনের ঐতিহ্যে ভারতীয় দর্শনের প্রভাব৷ সুস্পষ্ট। ভারতীয় দর্শনের তিনি দার্শনিক গোষ্ঠী ও তাদের দর্শন চিন্তাদ্বারা বাংলাদেশ দর্শন প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছে। যেমন- চার্বাক দর্শনের ভোগের ধারণা, বেদ বিরোধী চিন্তাধারা, স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার ধারণা, আত্মার ধারণা, জৈন দর্শনের প্রত্যক্ষণের ধারণা, আত্মার মুক্তির ধারণা, বৌদ্ধ দর্শনের চারটি আর্য সত্যের ধারণা, আত্মবাদের ধারণা, নির্বান
লাভের ধারণা, সাংখ্য দর্শনের পুরুষ ও প্রকৃতির ধারণা, নিরীশ্বরবাদী ধারণা, যোগ দর্শনের যোগাভ্যাসের ধারণা, প্রমাণের
ধারণা, ন্যায় দর্শনের প্রত্যক্ষ ও অনুমানের ধারণা, পরনতক্তের ধারণা, আত্মার মুক্তির ধারণা, ঈশ্বরতত্ত্ব, শ্রুতির ধারণা, বৈশ্বেষিক দর্শনের দ্রব্যের ধারণা, পদার্থের ধারণা, ঈশ্বরের ধারণা, মীমাংশা দর্শনের আত্মার ধারণা, বেদের ধারণা, বেদান্ত দর্শনের উপনিষদের ধারণা, ব্রহ্মের ধারণা, মায়ার ধারণা, বন্ধনমুক্তির ধারণা বাংলাদেশের দর্শনে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ দর্শনের দার্শনিক ঐতিহ্যের ধারায় ভারতীয় দর্শনের প্রভাবকে তাই অস্বীকার করা যায় না বরং এগুলো
বাংলাদেশ দর্শনের গতি প্রকৃতিকে বিশিষ্টতা দান করেছে।
২. চর্যাপদ, শ্রী কৃষ্ণ কীর্তনের প্রভাব : বাংলাদেশ দর্শনের ঐতিহ্যের ধারার চর্যাপদ ও শ্রী কৃষ্ণকীর্তনের প্রভাবকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। চর্যাপদের সত্ত্বা ও অবভাসের ধারণা, সাধন তত্ত্ব, জগতের প্রকৃতি, অধিবিদ্যক ধারণা, বর্ণ বৈষম্য প্রভৃতি বিষয় বাংলাদেশ দর্শনে প্রবেশ করেছেন। আবার, শ্রী কৃষ্ণকীর্তনের একটা শক্তিশালী প্রভাব বাংলাদেশ দর্শনে দেখতে পাওয়া যায়। কৃষ্ণের আরাধনা করা, প্রেম, ভক্তি ও করুণার ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা, অপরের কল্যাণে আপন
স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে বিশ্বজনীন প্রেমানুভূতির ধারা প্রতিষ্ঠা করার শিক্ষা বাংলাদেশ দর্শনে প্রবেশ করেছে।
৩. সুফিবাদ ও বাউলবাদ : বাংলাদেশ দর্শনের ঐতিহ্যে সুফিবাদ ও বাউলবাদের একটি শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। মানবদেহকে কেন্দ্র করে বাউল দর্শনের উদ্ভব। এ দেহতত্ত্বের ধারণা বাংলাদেশ দর্শনে প্রবেশ করেছে। আবার সুফিবাদের সাধন প্রণালি, পরম সত্তার সাথে ব্যক্তির মিলনের ইচ্ছা, আল্লাহর একত্ব প্রতিষ্ঠা করা। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা
প্রভৃতি বিষয় বাংলাদেশ দর্শনকে বিশিষ্টতা দান করেছে।
বাংলাদেশ দর্শনের ঐতিহ্যের ধারণার মানবতাবাদ : বাংলাদেশ দর্শনের ঐতিহ্যের ধারণার মানবতাবাদ একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। মানবতাবাদ এমন একটি মতবাদ যে মতবাদ মানুষকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করে। কিভাবে মানুষের বৃহত্তর কল্যাণসাধন করা যায় সেটি নিশ্চিত করাই মানবতাবাদের উদ্দেশ্য। মানবতাবাদ দুটি কথা খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। যেমন-
ক. মানবকল্যাণের ধারণায় মনুষত্বের ধারণাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করতে হবে।
খ. ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য ধর্ম, এ নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাংলাদেশ দর্শনের ঐতিহ্যের ধারার এ নীতিগুলো তার স্থান করে নিয়েছে।
৫. পাশ্চাত্য দর্শনের প্রভাব : বাংলাদেশ দর্শনের ঐতিহ্যের ধারণায় পাশ্চাত্য দর্শনের প্রভাব রয়েছে। বেন্থাম ও মিলের উপযোগবাদ, প্লেটো, সক্রেটিস, এরিস্টটলের দর্শন, ইবনে সীনার দর্শন, পাশ্চাত্যের মুসলমানদের অবদান ও আবিষ্কারের ধারণা বাংলাদেশ দর্শনে প্রবেশ করেছে। এসব উপাদানের অনুপ্রবেশের ফলে বাংলাদেশ দর্শন তার আপন গতিধারা ফিরে পেয়েছে।
৬. ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও বেঙ্গল রেনেসাঁ : বাংলাদেশ দর্শনের গতিধারার ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও বেঙ্গল রেনেসাঁর প্রভাব রয়েছে। ইউরোপীয় রেনেসাঁ পাশ্চাত্যের সার্বিক জীবনযাত্রার গতিধারা বদলে দিয়েছিল, মানুষের জীবনকে করেছিল সহজ ও প্রযুক্তি নির্ভর। আর বেঙ্গল রেনেসাঁ বাংলাদেশের সমাজে বিদ্যমান থাকা ধর্মীয় কুসংস্কার দূর করেছিল, শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়েছিল, মানুষের মর্যাদাকে বৃদ্ধি করেছিল। তাই বাংলাদেশ দর্শনের দার্শনিক ঐতিহ্যের ধারায় এগুলোর
গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশ প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন বিদেশি শক্তির দ্বারা শাসিত হয়েছে। এ দীর্ঘসময়ে বিদেশি শক্তির নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি ও চিন্তাধারা বাংলাদেশের সমাজে প্রবেশ করেছে। ফলে বাংলাদেশিদের জীবন ধারার গতির সঞ্চার হয়েছে। তবে বাংলাদেশ দর্শন বিশ্বের বিভিন্ন দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হলেও এটি কখনো নিজস্ব চিন্তাধারাকে বর্জন করেননি বরং পাশ্চাত্যের উপাদানের সাথে নিজস্ব চিন্তাধারার মিলন ঘটিয়ে বাংলাদেশ দর্শনকে সমৃদ্ধ করেছে।