বাংলাদেশ সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

অথবা, বাংলাদেশ সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক
অথবা, বাংলাদেশ সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক
অধিকারগুলো আলোচনা কর।
অধিকারগুলো বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষ সাধারণত জীবনযাপনের প্রয়োজনে এবং নিজের শক্তি ও গুণাবলির পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য অপরের সহযোগিতা ও সাহচর্য কামনা করে। এর ফলেই সমাজ তথা রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। রাষ্ট্র নাগরিকদের আনুগত্যের দাবিদার। নাগরিকদের জীবন সুন্দর ও পূর্ণাঙ্গ করে তোলার মধ্যেই রাষ্ট্রের সার্থকতা নিহিত রয়েছে। রাষ্ট্রের গুণ বিচারের জন্য তলিয়ে দেখতে হবে ঐ রাষ্ট্রজনগণের জন্য কতদূর সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করতে সমর্থ হয়েছে। লাস্কির মতে, “রাষ্ট্রের পরিচয় মিলে সে রাষ্ট্রে কর্তৃত্ব সংরক্ষিত অধিকারের মধ্যে। গণতান্ত্রিক সংবিধানের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও নাগরিক অধিকারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা।”
বাংলাদেশের সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারসমূহ : বাংলাদেশ সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ হতে ৪৭
অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মৌলিক অধিকারসমূহ নিম্নরূপ :
১. আইনের চোখে সবাই সমান : সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদে আইনের চোখে সকলেই সমান এবং সকলেই আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। রাষ্ট্র কেবল ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ ইত্যাদির ব্যাপারে বৈষম্য প্রদর্শন করবে না, সকল সম্প্রদায়ের লোকই অগ্রগতির স্বার্থে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
২. ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষদের বৈষম্য করা যাবে না : ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয় ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী-পুরুষ ভেদে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না এবং উক্ত কারণে নাগরিককে সাধারণ বিনোদন ও বিশ্রামকেন্দ্রে কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে বঞ্চিত করা যাবে না। রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বস্তরে নারী ও পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবে।
৩. সরকারি নিয়োগ লাভের অধিকার : বাংলাদেশ সংবিধানে ২৯নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী চাকরিতে নিয়োগ লাভের সুযোগ সকল ব্যক্তির থাকবে। আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন নাগরিকদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রের
চাকরিতে নিয়োগ দিতে হবে।
৪. বিদেশি রাষ্ট্রের উপাধি গ্রহণ : ৩০নং অনুচ্ছেদে বলা হয়, রাষ্ট্রের বিনা অনুমতিতে কোনো নাগরিক কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নিকট হতে কোনো উপাধি, সম্মাননা বা পুরস্কার গ্রহণ করতে পারবে না।
৫. জীবনধারণ ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা : বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১ ও ৩২নং অনুচ্ছেদে আইনানুযায়ী ছাড়া কারো জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির ক্ষতি করা যাবে না। আইনানুগ ব্যবস্থা ছাড়া জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা হবে না।
৬. গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ : সংবিধানের ৩৩নং অনুচ্ছেদের বিধান ছিল যে, কোনো গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কারণ জ্ঞাপন না করে আটক রাখা যাবে না। তাকে গ্রেফতারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্য আদালতে হাজির করতে হবে।
৭. জোরপূর্বক শ্রম নিষিদ্ধ : সংবিধানের ৩৪নং অনুচ্ছেদে কোনো নাগরিককে জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োগ করা যাবে না। উল্লেখ্য, সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য নয়।
৮. সুবিচারের অধিকার : সংবিধানের ৩৫নং অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকই বিচার ও শাস্তি সম্পর্কে উপযুক্ত রক্ষাকবচ. ও নিরাপত্তা লাভ করবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত কর্তৃক দ্রুত প্রকাশ্য বিচার লাভ করবে।
৯. চলাফেরার স্বাধীনতা : সংবিধানের ৩৬নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সকল নাগরিক বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধে চলাফেরা করতে পারবে। চলাফেরা ও বাসস্থান স্থাপনের উপর কোনো প্রকার বাধানিষেধ থাকবে না।
১০. সমাবেশের স্বাধীনতা : বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৭নং অনুচ্ছেদে জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হয়ে জনসভা এবং শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
১১. সংগঠনের স্বাধীনতা : সংবিধানের ৩৮নং অনুচ্ছেদে জনশৃঙ্খলা বা নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংগঠন করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
১২. চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা : সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের চিন্তা বিবেকের স্বাধীনতা, বাক ও ভাব প্রকাশের অধিকার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে।
১৩. পেশার স্বাধীনতা : সংবিধানের ৪০নং অনুচ্ছেদে যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক ব্যক্তির আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ সাপেক্ষ যে কোনো আইনসংগত পেশা বা বৃত্তি গ্রহণ করতে এবং যে কোনো আইনসংগত কারবার বা ব্যবসায় পরিচালনা করতে পারবে।
১৪. ধর্মীয় স্বাধীনতা : সংবিধানের ৪১নং অনুচ্ছেদে আইন, জনশৃঙ্খলা নৈতিকতা সাপেক্ষ প্রত্যেক নাগরিকের যে কোনো ধর্মের অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে এবং প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রয়েছে।
১৫. সম্পত্তির অধিকার : সংবিধানের ৪২নং অনুচ্ছেদে আইন দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ সাপেক্ষ প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর বা বিলি ব্যবস্থা করার অধিকার রয়েছে। আইনের কর্তৃত্ব ছাড়া কোনো সম্পত্তি
বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্তকরণ বা দখল করা যাবে না।
১৬. গৃহ নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার অধিকার : সংবিধানের ৪৩নং অনুচ্ছেদে সকল নাগরিকের নিজগৃহে নিরাপত্তা ভোগ করতে পারবে। রাষ্ট্রদ্রোহিতা ছাড়া কারো পত্রাদির গোপনীয়তা ভঙ্গ করা যাবে না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, মৌলিক অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কোন দেশ কতখানি গণতান্ত্রিক ও উদারনৈতিক তা বুঝা যায় সে দেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো পর্যালোচনার মাধ্যমে।