অথবা, বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের প্রণীত প্রথম সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশ সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো কী? আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৭২ সালের সংবিধান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ দখলদার মুক্ত হয় এবং স্বাধীন হয়। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের গণপরিষদ নতুন দেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের মহৎ কাজে আত্মনিয়োগ করে। সংবিধান প্রণয়নের জন্য একাধিক্রমে তিনটি অধিবেশনে মিলিত হন। অবশেষে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর গণপরিষদের অধিবেশনে
সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকরী হয়। মূল সংবিধান প্রণয়নের পর থেকে আজ অবধি ১৬টি সংশোধনী হয়েছে।
১৯৭২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য : বাংলাদেশের সংবিধান বিভিন্ন দিক দিয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও অনন্য। এ সংবিধান বাঙালি জাতিকে দেয় এক অপূর্ব প্রেরণা। নিচে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো :
১. লিখিত দলিল : বাংলাদেশের সংবিধান একটি লিখিত দলিল। এতে সনব্যবস্থার নিয়মনীতিগুলো বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ আছে। এতে ১৫৩টি অনুচ্ছেদ ও ১১টি ভাগ, একটি প্রস্তাবনা ও ৪টি তফশিল আছে।
২. রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি : বাংলাদেশ সংবিধানে অন্যান্য রাষ্ট্রের সংবিধানের ন্যায় কয়েকটি রাষ্ট্রীয় কর্তব্য নির্দেশক নীতি গৃহীত হয়। এগুলো রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসেবে পরিচিত। এগুলো হলো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র,
ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ। এসব নীতির বাস্তবায়ন রাষ্ট্রের কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃত হলেও সেগুলো আদালতে বলবৎযোগ্য ছিল না।
৩. সংবিধানের প্রাধান্য : এ সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সে ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এ সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। কোনো আইন এ সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্য হলে তা যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হয়ে যাবে।
৪. সংসদীয় ধরনের সরকার ব্যবস্থা : ১৯৭২ সালের সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো বাংলাদেশের জন্য সংসদীয় প্রকৃতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন। রাষ্ট্রপতি একজন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান ছিলেন। প্রকৃত শাসন ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী সমেত মন্ত্রিসভার ওপর ন্যস্ত। মন্ত্রিসভার সদস্যগণ সংসদের সদস্য এবং তারা যাবতীয় কার্যের জন্য
সংসদের নিকট দায়ী থাকতেন।
৫. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা : সুপ্রিম কোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত। মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ এর পরিপন্থী যে কোনো আইনকে বাতিল করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের আছে।
৬. এক কক্ষ আইনসভা : বাংলাদেশের আইনসভা হবে এক কক্ষবিশিষ্ট এবং শাসনব্যবস্থা হবে এককেন্দ্রিক প্রকৃতির।
৭. মৌলিক অধিকার : এ সংবিধানে নাগরিকগণকে ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, সাম্যের অধিকার প্রভৃতি মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। অবশ্য সংসদ এসব অধিকারের ওপর আইনগত বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে বলে বলা হয়।
৮. সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা : ১৯৭২ সালের সংবিধানের একটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো এতে সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। অর্থাৎ, বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র উভয় নীতিকেই গ্রহণ করা হয়।
৯. দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান : সংবিধান সংশোধনের বিশেষ পদ্ধতি বিদ্যমান। কোনো সংশোধনী বিল জাতীয় সংসদের অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত হয়ে রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে সংশোধনী পাস হয়।
১০. মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা : নাগরিকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথ উন্মুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে এ সংবিধানের ছয় ভাগে মোট ২২ ধারায় জনগণের মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে এবং এসব অধিকার বলবৎ করার উপযুক্ত ব্যবস্থাও সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
১১. উপাধিসর্বস্ব রাষ্ট্রপতি : বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদের ভোটে ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। তিনি উপাধিসর্বস্ব রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ করেন।
১২. দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা : দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয় যে, কোনো সংসদ সদস্য তার নিজ দল হতে পদত্যাগ করলে অথবা সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে বা দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ করলে তিনি সদস্য পদ হারাবেন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্যই এরূপ ব্যবস্থা করা হয়েছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, সংবিধান একটি রাষ্ট্রের জন্য রক্ষাকবচ। তাই সমাজ কাঠামোর সাথে সংগতি রক্ষা করে রাষ্ট্রের অগ্রগতি ও প্রগতি সুনিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রপরিচালনার দলিল সংবিধানের সংশোধন করতে হয়। তদ্রূপ ১৯৭২ সালের সংবিধানের ক্ষেত্রেও বেশকিছু পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধান ছিল একটি আদর্শ সংবিধান। পৃথিবীতে যাবতীয় সংবিধানের সারবস্তু হচ্ছে ১৯৭২ সালের সংবিধান। কিন্তু বারবার সংবিধান সংশোধনের
মাধ্যমে এর আসল চরিত্রটি বদলে ফেলা হয়েছে। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ওপর অদ্যাবধি ১৬টি মৌলিক সংশোধনী আনা হয়েছে। (তবে ১৬তম সংশোধনী সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল ঘোষিত)