অথবা, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর প্রদত্ত ভাষণের গুরুত্ব লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সমার্থক। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জেলে বন্দি ছিলেন। পাকিস্তান সরকার ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদান করলে ১০ জানুয়ারি স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে পৌঁছে বঙ্গবন্ধু সোজা চলে যান রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য। রেসকোর্স ময়দানে তিনি জাতির উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ প্রদান করেছিলেন। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রূপরেখা সংবলিত। নিচে বঙ্গবন্ধুর ১০ জানুয়ারির ভাষণের তাৎপর্য বর্ণনা করা হলো :
বঙ্গবন্ধুর ১০ জানুয়ারির ভাষণ : বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানে তার আবেগাক্রান্ত ভাষণে বলেন, “ভায়েরা আমার লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ দানের পর আজ আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, গত ৭ মার্চ আমি রেসকোর্স ময়দানে বলেছিলাম দুর্গ গড়ে তোলো। আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। বাংলাদেশ আজ মুক্ত। গত ৯ মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাকে বিরান করেছে। বাংলার লাখো মানুষের আজ খাবার নেই। অসংখ্য লোক গৃহহারা, ইয়াহিয়া খান আমার ফাঁসির হুকুম
দিয়েছিলেন। আমি বাঙালি, আমি মুসলমান, তাই বলেছি, ক্ষমা চাই না। তাদের বলেছি, তোমরা মারলে ক্ষতি নেই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌছে দিও।”
১. দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : রাষ্ট্রনায়কের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান ছিলেন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। সৃষ্টিশীল আগামীর ইঙ্গিত স্পষ্ট হয় রাষ্ট্রনায়কের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন কথা ও কাজে ১০
জানুয়ারির ভাষণে আমরা অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বঙ্গবন্ধুকে পাই।
২. বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্বে বাংলাদেশ : বাঙালি আর বাংলাদেশ ছিল বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব সংলগ্ন। বঙ্গবন্ধু ১০ মাস তাঁর দেশ ও মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন কিন্তু তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি, দূরদৃষ্টি প্রমাণ করে তার সমস্ত চিন্তা চেতনা ও ধ্যানধারণার।
৩. জাতি গঠনের ইঙ্গিত : বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে জাতি গঠনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত গোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তুলতে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
৪. কৃতজ্ঞতা প্রকাশ : বঙ্গবন্ধু ভাষণের শুরুতে যাদের প্রাণের ও ত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।” লক্ষণীয় এ
স্বাধীনতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ লালিত প্রতীতিও ছিল। কারণ তাঁর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস থেকে উচ্চারিত হয়েছিল, “আমি জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।”
৫. সহজ স্বীকারোক্তি : একই সমান্তরালে লক্ষণীয় বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের ভাষণে স্বীকার করেছেন, “বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার” অবদান অনেক। কারণ “আপনারাই জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন।” আরো বিস্তৃত স্বীকারোক্তি ছিল। “বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অংশগ্রহণকারী সকল শ্রেণির জনতাকে আমি পরম কৃজ্ঞতার সাথে সালাম জানাই।”
৬. রাষ্ট্রীয় রূপরেখা প্রদান : বঙ্গবন্ধুর ১০ জানুয়ারি প্রত্যাবর্তনের ভাষণে রাষ্ট্রীয় রূপরেখা সম্পর্কে ধারণা দেন। “বিধ্বস্ত বাংলাকে নতুন করে গড়ে তুলুন। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা। আমি প্রেসিডেন্ট নয়, নেতা হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই বলছি।” আর্থসামাজিক রূপরেখাটি নির্দেশ করার পাশাপাশি আদর্শিক ভিত্তিটিও নির্দেশিত হয়েছিল এমনভাবে বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি কোনো ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না, রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। পরবর্তীতে সংযোজিত হয় জাতীয়তাবাদ।
৭. বাঙালি সম্পর্কে উচ্চ ধারণা : বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। স্বাধীন বাংলাদেশ যে বাঙালিরা গড়ে তুলতে পারবে সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ছিল।
৮. মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের অবদান স্বীকার : বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বহির্বিশ্বের অবদানকে অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকার করেছেন। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন ভারত সরকার, জনগণ ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন ব্রিটেন, জার্মান, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি এবং মার্কিন জনগণের প্রতি।
৯. বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আহ্বান : সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশের জন্য বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি কূটনৈতিক দিক দিয়ে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য তিনি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন, “বিশ্বের সকল মুক্ত রাষ্ট্রকে অনুরোধ করছি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন।” যুদ্ধবিধ্বস্ত এ দেশ গড়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্যের অনুরোধ ছিল।
অনতিবিলম্বে জাতিসংঘের সদস্য পদ দাবি করা হয়েছিল।
১০. স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতি নমনীয়তা : মুক্তিযুদ্ধে যারা গণবিরোধী ভূমিকা পালন করেছিল স্বাধীনতার পর তাদের প্রতি প্রতিহিংসা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। তাদের বিরুদ্ধে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এদের বিচার হবে সে ভার সরকারের উপর ন্যস্ত রাখুন।
১১. পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের রূপরখো : পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের রূপরেখা নির্দেশ করলেন। “আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সাথে আর না। মরে যাবে তবু বাঙালি স্বাধীনতা হারাতে পারে না। আমি আপনাদের মঙ্গল কামনা করি। আমরা স্বাধীন এটা মেনে নিন। আপনারা স্বাধীনভাবে থাকুন।”
১২. মুসলিম বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের ইঙ্গিত : মুক্তিযুদ্ধে মুসলিম দেশগুলো পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে পাকিস্তানকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছে। তবু বঙ্গবন্ধু বললেন, “জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র।”
১৩. ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার ; ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। তিনি দ্রুত ভারতীয় সৈন্য দেশে পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমাদের সাথে দিল্লিতে শ্রীমতি গান্ধীর আলাপ হয়েছে আমি যখনই বলব, ভারতীয় সেনাবাহিনী তখনই দেশে ফেরত যাবে। ১৯৭২ এর ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা অনুযায়ী ভারতীয় সেনাবাহিনী
ফেরত যায়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে রেসকোর্স ময়দানে যুগান্তকারী ভাষণ প্রদান করেন। লাখো জনতার সামনে তিনি মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা অর্জন, ত্যাগ তিতিক্ষা ও নির্যাতিতদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। সাথে সাথে একটি সদ্য স্বাধীন দেশকে কীভাবে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলা যায় তার
একটি রূপরেখা ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের ভাষণ ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের জন্য অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ, যা একটি সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়তে সহায়ক ছিল।