দূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্যসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শোষণ উল্লেখ কর।
অথবা, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি রাজনৈতিক বৈষম্য সম্পর্কে লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা 🙁 দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গঠিত হয় স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র) লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে মূলত পশ্চিম পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানিরা বিভিন্ন কূটকৌশল অবলম্বন করে পূর্ব পাকিস্তানকে দমিয়ে রাখার ষড়যন্ত্রে সর্বদা লিপ্ত ছিল) পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু হতে ঔপনিবেশিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করতে থাকে।(পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী
সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা পূর্ব
পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক নীতি অনুসরণ করে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য : নিচে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য আলোচনা করা হলো :
রাজনৈতিক বৈষম্য : পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে দুর্বল করার জন্য এবং শোষণ ও শাসন করার জন্য শুরু থেকেই রাজনৈতিক বৈষম্য ও নিপীড়ন শুরু করে। যথা :
১. লাহোর প্রস্তাব উপেক্ষিত : মূল লাহোর প্রস্তাবে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কূটকৌশল অবলম্বন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যা বাঙালিদের স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধিকাংশ অধিবাসী পূর্ববাংলার অধিবাসী ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলার অধিবাসিদের রাজনৈতিক মর্যাদা না দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মুখোমুখি করে রাখা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে করা হয় পাকিস্তানের রাজধানী। এছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানসমূহ পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপন করা হয়। ফলে লাহোর প্রস্তাব সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত হয়।
২. বাঙালি স্বার্থের প্রতি অবহেলা : পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসক শ্রেণি শুরু থেকেই বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ববাংলার স্বার্থের প্রতি অবহেলা শুরু করে। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানে প্রথম নির্বাচন হয়েছিল। এ নির্বাচনে মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। কৃষক শ্রমিক পার্টির প্রধান ফজলুল হকের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এ মন্ত্রিসভা সফল হতে দেয়নি।
৩. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন উপেক্ষিত : পাকিস্তানের সংবিধানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অহেতুক হস্তক্ষেপ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়িত হতে পারিনি। বিভিন্ন অজুহাতে কেন্দ্রীয় সরকার অ্যাচিতভাবে প্রাদেশিক আইন সভায় হস্তক্ষেপ করতো। বাঙালিদের কিভাবে শাসনক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায় তা নিয়ে সর্বদা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকতো পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার।
৪. প্রতিনিধিত্বের বৈষম্যের চিত্র : পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় ৫৬% বাঙালি হলেও একমাত্র হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর আমল ছাড়া ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব কখনো ২৫% থেকে ৪৭% অতিক্রম করেনি। ঐ সময়ের ২২১ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী ছিল যাদের মধ্যে ৯৫ জন ছিল
বাঙালি। ৯ জন সরকারপ্রধানের মধ্যে ৩ জন ছিল পূর্ব বাংলার এর মধ্যে নাজিমুদ্দীন ছিলেন উর্দু ভাষী। তিনি বাংলা ভাষা বিরোধী জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। আইয়ুব খানের শাসনামলে ৬২ জন মন্ত্রীর মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ২২ জন। এরা কোনো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাননি।
৫. গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনায় অনীহা : গণতান্ত্রিক আদর্শ ও সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন ছিল পূর্ব পাকিস্তানিদের অন্যতম প্রধান দাবি। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনায় অনীহা দেখাতে থাকে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণীত হয়, যেখানে বাঙালিদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব ছিল না। এ সংবিধানে পূর্ব বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তান নাম দেওয়া হয় এবং পাকিস্তানকে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণার মাধ্যমে একটি সাম্প্রদায়িক’ রাষ্ট্র গঠন করা হয়। সংবিধানে সমস্ত ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত করার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা হয়।
৮০, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সামরিক হস্তক্ষেপ : ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে গণতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটায়। আইয়ুব খান মনেপ্রাণে গণতন্ত্র ও পূর্ব পাকিস্তান বিরোধী ছিলেন। তিনি ক্ষমতা দখল করে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস করে।
পা বাঙালি নেতৃবৃন্দের প্রতি কঠোর মনোভাব : ১৯৫৮ সালের পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালি নেতৃবৃন্দ অধিকাংশ সময় জৈলে কাটিয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয়ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।
৮. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাঙালিদের অবস্থান : পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের পররাষ্ট্র দপ্তরে নিয়োগ করতো না। কারণ পাকিস্তানি পররাষ্ট্রনীতি একমাত্র প্রতিক্রিয়াশীল চক্র দ্বারা প্রণীত হতো। বাঙালিদের প্রগতিশীল আদর্শকে তারা মূল্য দিত না। এ কারণে পররাষ্ট্র দপ্তরের ১০৪ জন প্রথম শ্রেণির কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ৩০ জন ছিল বাঙালি। দ্বিতীয় শ্রেণির নন গেজেটেড ২০৪ জন কর্মচারীর মধ্যে বাঙালি ছিলেন ৫৫ জন।
প্রশাসনিক বৈষম্য : নিচে প্রশাসনিক বৈষম্যসমূহ তুলে ধরা হলো :
শাসনব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদ হতে বাঙালিরা বঞ্চিত : সেক্রেটারী ও মন্ত্রীর পদটি ছিল রাজনৈতিক পদ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলার শিক্ষিত ও যোগ্যতাসম্পন্ন নাগরিকদের এ পদে নিয়োগ করতো না। মন্ত্রিপরিষদে দেখা যায় যে, লিয়াকত আলী খানের সময় (১৯৪৭-১৯৫১) পর্যন্ত মাত্র ৩১.২%, নাজিমুদ্দিনের সময় (১৯৫১-৫৩) মাত্র ৪০%, আইয়ুব খানের সময় মাত্র ৩২% এবং ইয়াহিয়া খানের সময় মাত্র ৪৫. ৫% মন্ত্রী ছিলেন বাঙালি। এদের কেউ গুরুত্বপূর্ণ পদ
পাননি। ১৯৬৪-১৯৬৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের ১৭ জন সেক্রেটারীর মধ্যে মাত্র দুজন ছিল বাঙালি তাও আবার ভারপ্রাপ্ত।
প্রশাসনিক বিভাগে বিভিন্ন স্তরে বাঙালিরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যেমন- পাকিস্তান রেলওয়ের ৮ জন বোর্ড ডিরেক্টরের মধ্যে মাত্র ১ জন ছিল বাঙালি, রেডিও পাকিস্তানের ২০ জন ডিরেক্টরের মধ্যে৷১৯ জন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে ৮৪% ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি এবং ১৬% ছিল বাঙালি। ১৯৬৬ সালের এক হিসাব অনুযায়ী ১৩টি কর্পোরেশনের মধ্যে ১টির চেয়ারম্যান ছিল বাঙালি। অন্যদিকে ১৯৬৩
সালের হিসেবে জানা যায় যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাত্র ৩.৪% বাঙালি নিযুক্ত ছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বৈষম্যনীতির মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের সকল রাজনৈতিক অধিকার ও প্রশাসনিক পদ থেকে বঞ্চিত করেছিল। তারা এক্ষেত্রে বাঙালিদের কোনো দাবিই মেনে নেয়নি। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বাঙালিদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্যের মাধ্যমে শোষণ ও নিপীড়ন করে দমিয়ে রাখার অপচেষ্টা করে। যার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান অধিকার ও দাবি আদায়ের স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত হয়।