অথবা, কী ঘটনা ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত বিভক্ত হয়েছিল? এ বিভক্তি কী অপরিহার্য ছিল?
অথবা, ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির কারণগুলো আলোচনা কর।
অথবা, কোন কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছিল? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৭৫৭ সালে ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা চলে যায় এককালে যারা ছিলেন এদেশীয় নৃপতি, কৃপা ও অনুগ্রহ প্রার্থী তাদের হাতে। ফলে বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয়। কিন্তুইতিহাসের ধর্ম হলো পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, একদিন যে বেনিয়ারা শূন্য হাতে ভারতবর্ষে আসেন তেমনি আবার শূন্য হাতে চলে যান। আর এরই মধ্যবর্তী ঘটনা হলো চরম দুঃখের ও কষ্টের। ভারতবর্ষের ইতিহাসে দেখা যায় পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে প্রায় ১৯০ বছর বেনিয়ারা এ উপমহাদেশে শোষণ চালায় এবং পরবর্তীতে
একপর্যায়ে ১৯৪৭ সালে ভারত ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হয়।
১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির প্রেক্ষাপট : অনেক কাহিনী ও ঘটনা পরিক্রমায় ভারত বিভক্তি সম্পন্ন হয়েছিল। নিচে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো :
১. ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন : ১৯৩৫ সালের ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানে আইন পাস করা হয়। কিন্তু এ আইনে যে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয় তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। আর তা বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে ভারতবাসীর যে অসন্তোষ তা আরও বেড়ে যায়। ফলে ভারতবাসীর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন আরো সোচ্চার হয়।
২. সাইমন কমিশন : ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের ধারা মোতাবেক এ আইনের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য দশ বছর পর একটি কমিশন প্রেরণ করার কথা বলা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দশ বছর পূর্ণ না হতেই ১৯২৭ সালে জন সাইমনের নেতৃত্বে ভারতে একটি কমিশন প্রেরণ করেন। এ কমিশনে কোনো ভারতীয় সদস্য না থাকায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ তা বর্জন করে। কিন্তু বর্জন করলেও এ কমিশন ভারত বিভক্তির পথকে অনেকটা সুগম করেছিল ।
৩. নেহেরু রিপোর্ট : পার্লামেন্টে বার্কেন হেডের কথার চ্যালেঞ্জ করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস মতিলাল নেহেরুকে সভাপতি করে ভারতের একটি সংবিধান রচনা করার জন্য কমিটি গঠন করেন। এ কমিটি তিন মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটি ভারত সম্পর্কিত শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করে। কিন্তু এ রিপোর্ট নিয়েও ব্রিটিশ সরকার টালবাহানা শুরু করেন। ফলে ভারতীয় জনসাধারণের মনে অসন্তোষের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।
৪. জিন্নাহর চৌদ্দ দফা : ১৯২৮ সালে নেহেরু রিপোর্ট প্রকাশিত হলে জিন্নাহ নেহেরু রিপোর্টের উপর কিছু সংশোধনী আনয়ন করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু কংগ্রেস জিন্নাহর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে জিন্নাহ নেহেরু রিপোর্টে যেমন হিন্দুদের স্বার্থের কথা বলা হয় তেমনি তিনি চৌদ্দ দফায় মুসলমানদের স্বার্থের কথা তুলে ধরেন। ফলে ভারতে এক রাজনৈতিক অস্থিতিশীল অবস্থা দেখা দেয়। এ ধরনের রাজনৈতিক অসন্তোষ ভারত বিভক্তি ত্বরান্বিত করেছিল।
৫. আইন অমান্য আন্দোলন : নেহেরু রিপোর্ট নিয়ে ব্রিটিশ সরকার টালবাহানা শুরু করলে জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারকে নেহেরু রিপোর্ট কার্যকরী করার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়। যদি মেনে নেওয়া না হয় তাহলে আইন অমান্য আন্দোলনের হুমকি দেয়। কিন্তু বাস্তবে তাই হয়। ফলে আইন অমান্য আন্দোলন ভারতে দেখা দেয়। আইন অমান্য আন্দোলনে ভারতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। তবে এটা ভারতবাসীকে অনেকটা প্রেরণা যুগিয়েছিল পরবর্তী আন্দোলনগুলোতে।
৬. গান্ধী আরউইন চুক্তি : আইন অমান্য আন্দোলন একপর্যায়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। তাই ভাইসরয় আরউইন ১৯৩১ সালের ৫ মার্চ একটি চুক্তি সই করেন গান্ধীজির সাথে। এ চুক্তি অনুযায়ী সমস্যা সমাধানের জন্য গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান জানান। ফলে ১৯৩০-৩১-৩২ সালে পরস্পর তিনটি গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান করা হয়। কিন্তু কোনো বৈঠকে সমস্যার তেমন সমাধান হয়নি। একপর্যায়ে ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ সরকার সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানে সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ঘোষণা করেন।
৭. ১৯৩৭ সালের নির্বাচন : ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী প্রদেশগুলোতে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। প্রদেশগুলোতে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কারণে ১৯৩৭ সালে এ প্রদেশগুলোতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে কৃষকপ্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ কোয়ালিশন করে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু এ মন্ত্রিসভা বেশিদিন টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়।
৮. লাহোর প্রস্তাব: ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পরবর্তী সরকার গঠন নিয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সাথে এক গোলযোগ দেখা দেয়। কারণ কংগ্রেস হিন্দু অধ্যুষিত প্রদেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং মুসলিম লীগ মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বাংলা প্রদেশে কৃষকপ্রজা পার্টির নেতা ফজলুল হক কংগ্রেসের সাথে কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে। আর এ প্রত্যাখ্যান করার ফলে মুসলমানরা আলাদা একটি জাতি হিসেবে স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার জন্য লাহোরে মিলিত হয় এবং একটি মুসলিম স্বার্থ
সম্পর্কিত প্রস্তাব পাস করে যা ‘লাহোর প্রস্তাব’ নামে খ্যাত।
৯. জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্ব : ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যখন শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে ঐকমত্যের অভাব তখন জিন্নাহ তাঁর বিখ্যাত দ্বিজাতি তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। এতে তিনি মুসলমানদেরকে আলাদা একটি জাতি হিসেবে
ঘোষণা করেন এবং স্বতন্ত্র আবাস ভূমি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব দেন।
১০. ত্রিপস মিশন : ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে জাপানি আক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যায়। এ ধরনের অবস্থায় ভারতীয় নেতারা ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের পরামর্শ দেয়। এছাড়া ব্রিটিশ সরকারও ভারত সম্পর্কিত মনোভাবের পরিবর্তন করেন। ফলে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৯৪২ সালে ভারতে একটি কমিশন প্রেরণ করেন। এ কমিশন ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের সাথে অনেক আলোচনা করে। কিন্তু কোন
ঐকমত্যে আসতে ব্যর্থ হলে ব্রিটিশ সরকার নিজস্ব পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এ প্রস্তাব ভারত বিভক্তির পূর্ব লক্ষণ ছিল।
১১. ভারত ছাড় আন্দোলন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতে জাপানি আক্রমণের ভীতি দেখা দেয়। ফলে ভারতীয় নেতারা উপলব্ধি করেন যে, ভারতের স্বার্থে ব্রিটিশ সরকারের ভারত ত্যাগ করা উচিত। তাই তারা আগস্ট প্রস্তাবের মাধ্যমে ব্রিটিশকে ভারত ছেড়ে যেতে বলেন। তবে ব্রিটিশ সরকার ভারত ছেড়ে না গেলেও অনেকটা ভিত্তি রচিত হয়েছিল।
১২. ১৯৪৬ সালের নির্বাচন : ১৯৪৬ সালে প্রদেশগুলোতে আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে এতে কেন্দ্রীয় নির্বাচনেরও কথা ছিল। এ নির্বাচনে মুসলিম লীগ শতকরা ৮৩.৪% ভোট পায়। যা আলাদা ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠা করার ভিত্তি রচনা করেছিল।
[উৎস : বাংলাদেশের ইতিহাস, ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন]
১৩. মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা : ভারতে শাসনতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা চরম আকার ধারণ করলে ব্রিটিশ সরকার তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি ক্যাবিনেট মিশন ভারতে প্রেরণ করেন। এ কমিশন ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা নিয়ে ভারতের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনায় আসতে ব্যর্থ হয়। ফলে মিশন নিজস্ব পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এ
পরিকল্পনার মধ্যে ভারত বিভক্তির বীজ নিহিত ছিল।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, পরিবর্তনই হলো ইতিহাসের ধর্ম। যেখানে শেষ সেখানে শুরু। ইতিহাসের এ নিয়মে যে বেনিয়ারা বাণিজ্যের জন্য একদা ভারতে আসত তাঁরা পরে ভারতের নিয়ন্ত্রণ কর্তা হন এবং প্রায় ২০০ বছর তাঁরা তাঁদের শাসন, শোষণ বজায় রাখতে সক্ষম হন। এ সময়ে তাঁরা ভারতবাসীর প্রতি যে চরম অত্যাচার নির্যাতন করেন তা তাঁদের পতন ডেকে আনে। ফলে একপর্যায়ে তাঁরা ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তবে এজন্য অনেক কারণসহ ভারতবাসীর ঐক্যবোধ দায়ী ছিল। তবে ভারত বিভক্তি ছিল অনেকটা ঐতিহাসিক দিক থেকে তাৎপর্যময়।