তুমি কী মনে কর লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল?

অথবা, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব কী? তুমি কী মনে কর যে, লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল?
অথবা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পটভূমিতে লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল হলো বাংলাদেশের জন্ম- ব্যাখ্যা কর।
অথবা, লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে কী স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস ও মুসলমানদের একটি পৃথক আবাসভূমির দাবি উত্থাপনের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ প্রস্তাব পরবর্তীতে মুসলমানদের আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিয়েছে এবং পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের দাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মূল এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হিসেবে কাজ করেছে। এ প্রস্তাবের সুদূরপ্রসারী ফলাফল হলো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি।
পটভূমি : লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি তৈরি হয় ঊনবিংশ শতক থেকে। এ সময় সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, হিন্দু উগ্রজাতীয়তাবাদী চেতনা বিস্তার লাভ করতে থাকে। এর ফলে মুসলমান স্বার্থ অরক্ষিত হতে থাকে ফলে মুসলমানরা
তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বিভিন্ন দাবি জানায় কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য জয়ের পরও যখন কংগ্রেস মুসলমানদের কথা চিন্তা না করে একক মন্ত্রিসভা গঠন করে তখন মুসলমানরা তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বাধ্য হয়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে লাহোর প্রস্তাব পেশ করে।
প্রস্তাব : ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগের এক অধিবেশনে ২৩ মার্চ এ. কে. ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব পেশ করে এবং ২৪ মার্চ তা গৃহীত হয়। লাহোর প্রস্তাবের মূল প্রতিপাদ্য হলো :
১. ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সংলগ্ন এলাকাসমূহকে অঞ্চলে চিহ্নিত করা।
২. ভারতের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন করা।
৩. স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠনের প্রয়োজনে ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাসমূহের সীমানা রদবদল করা।
৪. এসব স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের প্রদেশগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।
৫. ভারতের সকল অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার জন্য সংবিধানে কার্যকর ও বাধ্যতামূলক বিধান থাকবে।
লাহোর প্রস্তাবে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল কি না : লাহোর প্রস্তাব ভারতীয়
উপমহাদেশের মুসলিম জনসাধারণের মাঝে এক নতুন প্রেরণার সৃষ্টি করে। স্বতন্ত্র আবাসভূমির আশায় তারা আশান্বিত হয়ে উঠে। মূলত এ লাহোর প্রস্তাবের মাঝেই স্বাধীন বাংলাদেশের সুপ্ত বীজ লুক্কায়িত ছিল। নিচে তা ধারাবাহিকভাবে বিশ্লেষণ করা হলো :
লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম লীগকে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি ও দিকনির্দেশনা এনে দেয়। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের পৃথক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনে পরিণত হয়। অতি দ্রুত পাকিস্তান আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের ফলাফল এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । মুসলিম লীগের পক্ষে এ নির্বাচন ছিল পাকিস্তান ইস্যুর উপর রেফারেন্ডাম তুল্য।
২. ১৯৪৬ সালে জিন্নাহর নেতৃত্বে দিল্লি মুসলিম লেজিসলেটরস কনভেনশন এর মুসলমানদের একাধিক রাষ্ট্র পরিকল্পনাকে বাদ দিয়ে এক পাকিস্তান পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ ছিল লাহোর প্রস্তাবে রাষ্ট্র পরিকল্পনার
পরিবর্তনের শামিল। ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। ভারত উপমহাদেশের মুসলিম
সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল নিয়ে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান এবং বাকি অংশ নিয়ে সৃষ্টি হয় ভারত ইউনিয়ন।
৪. লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী ভারত বিভক্ত হলে পূর্বাঞ্চলে যেখানে বর্তমান বাংলাদেশ সেখানে ঐ সময়ই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা ছিল বাস্তবে তা হয়নি। ফলে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের সাথে চরম
বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়। এ অবস্থায় পূর্ব বাংলায় বাঙালিদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
৫. তাছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশের দুই প্রান্তে অবস্থিত দুই অঞ্চলকে শুধু ধর্মীয় কারণে একত্রিত রাখা প্রায় অসম্ভব ছিল। ধর্মীয় ঐক্য বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত শোষণ-
নিপীড়ন আড়াল করতে সক্ষম হয়নি।
৬. পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রাষ্ট্রভাষা নীতি ও বাঙালিদের ভাষা আন্দোলনের প্রতি প্রতিক্রিয়ায় এর নগ্ন প্রকাশ ঘটে। যে কারণে পাকিস্তানের শুরুতেই পূর্ব বাংলার জনসাধারণ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে এবং পরবর্তীতে ৬৬ এর ছয়দফা আন্দোলনে এ স্বায়ত্তশাসনের দাবি পুনরায় উত্থাপিত হলে জনগণ অধিক সচেতন হয়ে উঠে।
তিন ৭. অবশেষে ৭০ এর সাধারণ পরিষদ নির্বাচনে পাকিস্তান পিপল্স পার্টির ভরাডুবি পাকিস্তান ভাঙনের পথ প্রশস্ত করে এবং ‘৭১ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
সার্বিক আলোচনা : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, ১৯৪০ সালে গৃহীত লাহোর প্রস্তাব ছিল মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান প্রথম পদক্ষেপ। ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তা নিশ্চিত হয়। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়, যার শেষ পরিণতি ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। দ্বিজাতি তত্ত্ব সম্পর্কে জিন্নাহ বলেছেন, “We maintain and hold the Muslims and Hindus are two major nations by any definition or of a nation.” বস্তুত লাহোর প্রস্তাবের
ধারা অনুযায়ী পাকিস্তানের জন্ম না হওয়ার দরুন পূর্ববঙ্গের জনগণ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। অবশেষে ১৯৭১ এ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।