অথবা, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব কী? এতে কী বলা হয়েছিল আলোচনা কর ।
অথবা, লাহোর প্রস্তাব কী? এর বৈশিষ্ট্যসমূহ লিখ।
উত্সা৷ ভূমিকা : ব্রিটিশ ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক শাসনতান্ত্রিক ক্রমবিকাশের ইতিহাসে ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ শাসনতান্ত্রিক দলিল। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কে প্রথমবারের মতো একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব হিসেবে শেরে বাংলা কর্তৃক উত্থাপিত হলে সর্বসম্মতিক্রমে এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবে ভারতের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোর সমন্বয়ে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি অর্থাৎ রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানানো হয়। এ প্রস্তাবটি পাকিস্তান প্রস্তাব নামেও পরিচিত।
পটভূমি : ঊনবিংশ শতক থেকে উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, হিন্দু উগ্রজাতীয়তাবাদী চেতনার বিস্তার লাভ করতে থাকে। এর ফলে মুসলমান স্বার্থে বার বার আঘাত আসতে থাকে। এরপর থেকে মুসলমানরা নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্দোলন দাবি ও চুক্তি সই করে। কিন্তু তাতে তারা বরাবরই ব্যর্থ হয়। সর্বশেষে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলমানরা উল্লেখযোগ্য বিজয় পাওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেসরা মুসলমানদের স্বার্থের কথা সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে একক মন্ত্রিসভা গঠন করে এবং মুসলমানদের ন্যূনতম দাবি মেনে নিতে স্বীকৃতি জানায়। এতে ভারতীয় মুসলমানদের অখণ্ড ভারতের আশা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে যায়। তারা বুঝতে পারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভারত শাসন করে মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা করা সম্ভব নয়। এরই প্রেক্ষিতে মুসলিম লীগ এর সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্ব ঘোষণা করে এবং এর
ভিত্তিতে ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগ সভায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব পেশ করে ২৩ মার্চ। এটি ঘোষণার পর ২৪ মার্চ তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
লাহোর প্রস্তাবের ধারা বা বৈশিষ্ট্য : ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে অবিভক্ত পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরে মুসলিম লীগের অধিবেশন বসে। এ অধিবেশনে ২২ মার্চ শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হককে বাংলার বাঘ উপাধি প্রদান করা হয়। ২৩ মার্চ এ. কে. ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং ২৪ মার্চ এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। লাহোর প্রস্তাবের মূল
বৈশিষ্ট্য ছিল নিম্নরূপ :
১. “নিখিল ভারত মুসলিম লীগ দৃঢ়তার সাথে পুনঃ ঘোষণা করছে যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন এর মধ্যে যে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তা ভারতের উদ্ভূত অবস্থার প্রেক্ষিতে অসম্ভব ও অকার্যকর
বিধায় তা ভারতীয় মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।”
২. “সমস্ত সাংবিধানিক পরিকল্পনা নতুনভাবে বিবেচনা না করলে ভারতের মুসলমানরা অসন্তুষ্ট হবে এবং মুসলমানদের সমর্থন ছাড়া সংবিধান রচনা হলে কোনো সংশোধিত পরিকল্পনাও তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য
হবে।”
৩. “মুসলিম লীগের সুচিন্তিত অভিমত যে, ভারতে কোনো শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা কার্যকর হবে না অথবা মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না যদি না তা নিম্নলিখিত মূলনীতির উপর ভিত্তি করে রচিত না হয়’ :
ক. ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সংলগ্ন এলাকাগুলোকে অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।
খ. প্রয়োজন অনুযায়ী সীমানা পরিবর্তন করে ভারতীয় উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলকে এমনভাবে গঠন করতে হবে যাতে এ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এলাকাগুলো পরবর্তীতে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন করতে পারে।
গ. স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের প্রদেশ বা অঙ্গ রাজ্যগুলো স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমত্ব পাবে।
৪. “এ সমস্ত অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি অধিকার সংরক্ষণ এর জন্য তাদের মতামত অনুযায়ী সংবিধানে কার্যকরী ও বাধ্যতামূলক রক্ষাকবচ এর ব্যবস্থা করতে হবে এবং
ভারতবর্ষের যেসব এলাকায় মুসলমানরা সংখ্যালঘু সেখানে তাদের সাথে পরামর্শ করে এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে সুপরামর্শ সাপেক্ষে সংবিধানে তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় অধিকার ও স্বার্থরক্ষার জন্য কার্যকর ও বাধ্যতামূলক রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করতে হবে।” লাহোরের মূলধারাগুলো বিশ্লেষণ করলে ৫টি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় :
১. ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সংলগ্ন এলাকাসমূহকে অঞ্চলে চিহ্নিত করা।
২. ভারতের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন।
৩. স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠনের প্রয়োজনে ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর সীমানা পরিবর্তন।
৪. এসব স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের প্রদেশগুলো হবে সার্বভৌম ও স্বায়ত্তশাসিত।
৫. ভারতের সকল অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য সংবিধানে কার্যকর ও বাধ্যতামূলক বিধান তৈরি।
উপসসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, লাহোর প্রস্তাব গ্রহণের পর মুসলিম লীগের রাজনীতিতে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ আসে। মুসলমানদের মধ্যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত হয়। লাহোর প্রস্তাব শুধু হিন্দুদের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই নয় বরং পৃথক রাজনৈতিক অস্তিত্বের দাবি। লাহোর প্রস্তাবে মুসলমানদের
স্বার্থরক্ষার জন্য-পৃথক আবাসভূমির দাবি করাতে অনেকে একে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। পরবর্তীতে এ প্রস্তাবের অনিবার্য ফলাফল হিসেবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক একটি পৃথক মুসলমান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়।