অথবা, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের প্রেক্ষাপট বা পটভূমি আলোচনা কর।
অথবা, লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে লাহোর প্রস্তাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। একই সাথে এর ফলাফলও সুদূরপ্রসারী। ১৯৪০ সালের এ প্রস্তাব পেশ হওয়ার পরে মুসলমানদের সকল আন্দোলন এর দিক নির্ণয় করে এ লাহোর প্রস্তাব, যার অনিবার্য ফলাফল ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি।
লাহোর প্রস্তাব : ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, এতে বলা হয় ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে এক বা একাধিক রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে হবে। এ প্রস্তাবটি ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব হিসেবে খ্যাত। মুসলিম লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত লাহোরের এ অধিবেশনে তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হক এ প্রস্তাব সবার সামনে উত্থাপন করেন,
বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ২৪ মার্চ প্রস্তাবটি গৃহীত হয় ।
প্রেক্ষাপট বা পটভূমি : লাহোর প্রস্তাবের মূল বিষয় ছিল মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং স্বায়ত্তশাসন, সর্বপ্রথম এ দাবির সূত্রপাত ঊনবিংশ শতকে দেখা যায়, যেসব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪০ সালের লাহোর
প্রস্তাবে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি করা হয়েছে তা নিচে দেওয়া হলো :
১. স্যার সৈয়দ আহমেদ এর ভূমিকা : সর্বপ্রথম স্যার সৈয়দ আহমেদ ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে ঘোষণা করেন যে, ভারতে মুসলমান একটি পৃথক জাতি, তিনি লন্ডন টাইম পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে মুসলমানদের একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ পৃথক জাতি হিসেবে পৃথক নির্বাচনের দাবি জানান। এ কারণে বহু মুসলিমকে কংগ্রেসে যোগ দিতে বারণ করেন এবং পৃথক দল তৈরি করতে বলেন।
২. বঙ্গভঙ্গ ও মুসলিম লীগের জন্ম : ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা হয় কিন্তু হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গ রদ এর আন্দোলন শুরু করলে মসলমান স্বার্থ সংরক্ষণ এর জন্য ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগ এর জন্মের পর থেকেই তারা মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও পৃথক জাতি হিসেবে নিজেদের ভাবতে শুরু করে।
১৯০৯ সালে পৃথক জাতি হিসেবে স্বীকৃতি : মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি জানায়। ১৯০৯ সালের মর্লি মিন্টো সংস্কার আইনের মাধ্যমে মুসলমানের এ দাবি মেনে নেয়া হয়, ইংল্যান্ডের হাউস অব লর্ডস এ লর্ড মর্লি ঘোষণা করেন যে, ভারতের মুসলমানগণ শুধু একটি পৃথক ধর্ম অনুসরণ করে তা নয়, তারা সামাজিক আচরণ ও জীবনযাত্রার দিক দিয়ে পৃথক জাতির সমতুল্য।
৪. পৃথক নির্বাচনের দাবি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ও পরেও মুসলমানরা তাদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচনের দাবি জানাতে থাকে ৷ লক্ষ্ণৌ চুক্তি (১৯১৬) এবং জিন্নাহর চৌদ্দ দফা (১৯২৯) এর মূল প্রতিপাদ্য ছিল পৃথক নির্বাচন ও স্বায়ত্তশাসন।
৫. নেহেরু রিপোর্ট (১৯২৮) : নেহেরু রিপোর্ট ছিল অখণ্ড ভারত ধারণার উপর অনেক বড় ধাক্কা। এ রিপোর্ট মুসলমান স্বার্থ বিরোধী হওয়ায় মুসলমানরা তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একটি সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন কিন্তু তা সাব কমিটি দ্বারা অগ্রাহ্য হয়। এর ফলে অখণ্ড ভারত সম্পর্কে ভারতীয় মুসলিম নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারার পরিবর্তন হয়। তাদের
সম্পূর্ণ আশা ভঙ্গ হয় এবং তারা বুঝতে পারেন যে, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও ঐক্যবদ্ধ ভারত মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ আর সম্ভব নয়।
৬. হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রভাব : উপমহাদেশে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক দল কংগ্রেস শুরুতে অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে যাত্রা করলেও পরবর্তীতে শীর্ষস্থানীয় গোঁড়া হিন্দু নেতাদের মনোভাবের কারণে তা সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে রূপ লাভ করে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আরো ঘনীভূত হয় যখন জওহরলাল নেহেরু মন্তব্য করেন যে, ভারতে
২টি অস্তিত্ব লক্ষণীয় একটি সরকার অন্যটি কংগ্রেস। মূলত তাদের ধারণা ছিল ব্রিটিশরা চলে গেলে ভারতে হিন্দু সম্প্রদায় ভারত শাসন করবে।
৭. মুসলিম চিন্তাবিদদের প্রভাব : লাহোর প্রস্তাবে মুসলমানদের পৃথক ভূমির দাবির পিছনে মুসলিম চিন্তাবিদদের চিন্তাধারার প্রভাব করেছে। ১৯৩০ সালে মহাকবি আল্লামা ইকবাল এলাহাবাদে এক ভাষণে মুসলমান জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। ১৯৩৩ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ ৫টি মুসলিম এলাকার জন্য পাকিস্তান নামের উদ্ভাবন করেন। ১৯৩৫ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ জাফরুল ইসলাম ও আফজাল হোসেন কাদরী পুনরায় একই দাবি উত্থাপিত করেন।
৮. ১৯৩৭ সালে কংগ্রেসের একক মন্ত্রিসভা গঠন : ১৯৩৫ সালের আইন অনুসারে ১৯৩৭ সালে নির্বাচন হয়, মুসলিম লীগ উল্লেখযোগ্য আসন লাভ করে কিন্তু কংগ্রেসরা মুসলিম লীগের সাথে কোনো আলোচনা ছাড়াই একক মন্ত্রিসভা গঠন করে। ক্ষমতা গ্রহণের পরেই কংগ্রেস বিভিন্ন অফিস আদালতে কংগ্রেসের পতাকা উত্তোলন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্দে
মাতারম গাওয়া, রাষ্ট্রভাষা হিন্দি ঘোষণা করে। এটি ছিল মুসলিম স্বার্থ ও অস্তিত্বের উপর চরম আঘাত। এর ফলে জিন্নাহ বুঝতে পারেন যে, ঐক্যবদ্ধভাবে ভারত শাসন সম্ভব নয়।
৯. গোলটেবিল বৈঠক : ১৯৩৯ সালে লন্ডনে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় বিভিন্ন দল, সম্প্রদায় ও দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধি নিয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠক করে। হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সমাধানের জন্য চেষ্টা করা হলে তা ব্যর্থ হয়। কংগ্রেস মুসলমানদের ন্যূনতম দাবি মানতে অস্বীকার জানায়। ফলে মুসলিম লীগ পৃথক আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার দিকে ঝুঁকে পড়ে ।
১০. জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্ব : ১৯৩৯ সালে মুসলিম লীগের সভাপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার দ্বিজাতি তত্ত্ব (Two nation theory) ঘোষণা করে। তিনি বলেন, ভারতে হিন্দু-মুসলমান কখনো একটি জাতি ছিল না, তারা সম্পূর্ণ দুটি পৃথক জাতি । দুটি জাতির ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক প্রথা ও সাহিত্য সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক সূত্র থেকে আগত বলে মন্তব্য করেন। তার এ তত্ত্বের ভিত্তিতে ২৩ মার্চ এ. কে. ফজলুল হক সাহেব প্রস্তাব প্রকাশ করেন এবং ২৪ মার্চ তা বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে গৃহীত হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও বার বার মুসলমানদের স্বার্থের উপর আঘাত অখণ্ড ভারতের আদর্শকে ব্যর্থ করে তোলে। ১৯৩৭ এর নির্বাচনের পর কংগ্রেসের একক মন্ত্রিসভা গঠন এবং মুসলমানদের দাবি সম্পূর্ণরূপে অবজ্ঞা করার ফলে মুসলমানরা তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে বাধ্য হয় এবং লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে তাদের পৃথক আবাসভূমির দাবি জানায় ।