অথবা, ঔপনিবেশিক শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতা উদ্ভবের কারণ ও তার প্রভাব আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : যেকোনো শান্তিকামী দেশের জন্য সাম্প্রদায়িকতা অভিশাপস্বরূপ। সাম্প্রদায়িকতা একটি জাতি ও দেশের সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থায় অশান্তির বীজ বপন করে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় হিন্দু, মুসলিম সম্প্রদায় সৌহার্দের সাথে বসবাস করে আসছিল কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ভারতে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল এবং দীর্ঘমেয়াদি ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে সুকৌশলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব সৃষ্টি করে।
হিন্দু সম্প্রদায়কে অধিক সুবিধা প্রদান করে ব্রিটিশরা, অপরদিকে মুসলমান সম্প্রদায়কে সন্দেহের চোখে দেখত ব্রিটিশ সরকার। এর ফলে মুসলমান সম্প্রদায় সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত হয় এবং পিছিয়ে পড়ে।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভবের কারণ : ব্রিটিশদের শাসনামলে ভারতে নানা কারণে উভয় সাম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ চরম রূপ লাভ করে। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত : ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হলে লাভবান হন প্রধানত হিন্দু জমিদারগণ। অপরপক্ষে মুসলমানগণ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুসলমানরা ব্রিটিশ বিরোধী ছিল এবং শিক্ষিত জমিদার হিন্দুরা ব্রিটিশদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। যা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টিতে সহায়ক ছিল ।
২. রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপন : ব্রিটিশরা ভারতে বিভেদ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দীর্ঘস্থায়ী করতে তৎপর হয়। যার ফলে তারা ভাগ কর, শাসন কর নীতি অনুসরণ করে। ভাগ কর, শাসন কর নীতির মাধ্যমে সুকৌশলে ব্রিটিশ
শাসকগণ বাংলার হিন্দু মুসলমান বিভেদ সৃষ্টি করেছিল যা সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেয়।
৩. পক্ষপাতদুষ্ট নীতি গ্রহণ : ঔপনিবেশিক শাসনামলে ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন পক্ষপাতদুষ্ট নীতি গ্রহণ করেছিল। অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় হিন্দুরা এগিয়ে যায় আর মুসলমানরা পিছিয়ে পড়ে। আর্থিক ব্যপারে মুসলমান কৃষকগণ হিন্দু জমিদার ও ব্যবসায়ীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন ঋণের দায়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে মুসলমান সম্প্রদায় জমি হারাতে থাকে। ফলে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টি হয়।
৪. মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব : ব্রিটিশরা মুসলমান শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে। ফলে ভারতীয় মুসলমানগণ ব্রিটিশদেরকে ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। মুসলমানরা ছিল ব্রিটিশদের বিরোধী, অন্যদিকে হিন্দুরা ছিল ব্রিটিশদের সহায়ক শক্তি। যে কারণে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়।
৫. ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি : ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হয়। হিন্দু সমাজসংস্কারক ও কবিসাহিত্যিকগণ হিন্দু জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে, মুসলিম সমাজসংস্কারক ও আলেমগণ মুসলিম জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যা সাম্প্রদায়িকতার সূত্রপাত ঘটায়।
৬. কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা : ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতে কংগ্রেস একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস হিন্দু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। অনেক ক্ষেত্রে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত মুসলিম বিরোধী হয় যা সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করে।
৭. মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা : ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগ মুসলামনদের স্বার্থরক্ষায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অধিকাংশ সদস্য মুসলিম ছিল। ফলে হিন্দুসম্প্রদায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে।
৮. বঙ্গভঙ্গ : ব্রিটিশরা ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ করে মুসলমানদের সুবিধার জন্য। পূর্ব বাংলায় মুসলমান অধ্যুষিত হওয়ায় প্রশাসনিক কর্মসংস্থান ও আর্থিক সুবিধার জন্য মুসলমানগণ একে স্বাগত জানায় কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায় এর তীব্র বিরোধিতা করলে শেষ পর্যন্ত ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। যা উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বিভেদ সৃষ্টি করে।
৯. দ্বিজাতি তত্ত্ব : ধর্মের ভিত্তিতে মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্ব উপস্থাপন করলে ঔপনিবেশিক শাসনামলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ চরম আকার ধারণ করে। যা শেষ পর্যন্ত দাঙ্গার রূপ নেয়।
১০. লাহোর প্রস্তাব ও পৃথক আবাসভূমি : ভারতে মুসলমান সম্প্রদায় লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় মুসলমানরা পৃথক স্বাধীন আবাসভূমি দাবি করে। অন্যদিকে, হিন্দুরা ভারত বিভক্তিতে একেবারেই রাজি ছিল না। যার ফলে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠে। যা সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ঘটে।
সাম্প্রদায়িকতার ফলাফল : ব্রিটিশ আমলের শুরু থেকে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার যে চেতনা উন্মেষ হয় তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এ কারণে ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেসেও পরবর্তীতে সাম্প্রদায়িক মনোভাব ঢুকে পড়ে এবং এ কারণে অনেক মুসলমান রাজনীতিবিদ এ থেকে বিরত থাকে।
প্রথম বহিঃপ্রকাশ ১৯০৫ : ভারতের সাম্প্রদায়িকতার প্রথম চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হয় ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর। এ সময় ভারতে দুটি সম্প্রদায় তাদের স্বার্থের জন্য চূড়ান্ত দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। ভারতীয় হিন্দুরা অখণ্ড বাংলা চাই কিন্তু বাংলার মুসলমানরা তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য বাংলা বিভক্তির পক্ষে ছিল। এমনই অবস্থায় দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র মতানৈক্য দেখা দেয়। ১৯১১ সালে কংগ্রেস ও হিন্দুদের তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের সম্পর্কের চরম অবনতি হয়। এরই মধ্যে ভারতের মুসলমানরা তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কংগ্রেস হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিপক্ষ হিসেবে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ তৈরি করে। ১৯১১ সালের পর থেকে মুসলমান ও হিন্দু সম্পর্কের আর উন্নতি সম্ভব হয়নি। যদিও ১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌ চুক্তি এবং ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্যাক্ট এর মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিমের ঐক্যের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এরই মধ্যে বিভিন্ন সময় হিন্দু-মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার্থে বিভিন্ন দাঙ্গা হয়। ১৯২৮ সালে নেহেরু রিপোর্ট প্রকাশের পর তা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠে। মুসলমানদের দাবি মেনে না নেওয়ার কারণে মুসলমানরা হিন্দুদের প্রতি তীব্র বিরোধিতা করে। এরই প্রেক্ষিতে জিন্নাহ ১৯২৯ সালে চৌদ্দ দফা পেশ করে। ১৯৩২ সালের ব্রিটিশ সরকারের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ হিন্দু-
মুসলমান সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটায়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর কংগ্রেস মুসলমানদের অবহেলা করে মন্ত্রিসভা গঠন করে। ফলে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি আবার প্রবল ধাক্কা আসে এবং এ প্রেক্ষিতে জিন্নাহ তার বিখ্যাত দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রকাশ করে। দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব পেশ করা হয় যাতে বলা হয় মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্রের কথা। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় যার প্রমাণ বহন করে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ‘ভয়াবহ কোলকাতা দাঙ্গা’। এর অব্যবহিত পরে নোয়াখালী দাঙ্গার পরে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে বিরাট ফাটল ধরে। যা পরবর্তীতে ভারতের বিভক্তিকে অনিবার্য করে তোলে। ১৯৪০ সালের সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধির কারণেই ব্রিটিশ সরকার ভারতকে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ভাবতে শুরু করে এবং এ সাম্প্রদায়িকতার কারণেই ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি হয়ে পাকিস্তান এবং ভারতের সৃষ্টি হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাচীনকাল থেকে হিন্দু-মুসলিমগণ ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সাথে পাশাপাশি বসবাস করে আসছিল। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতে বিভক্তি সৃষ্টি করে ইংরেজরা সুকৌশলে ভারতকে শোষণ ও শাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘ করতে তৎপর ছিল। এর ফলে হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ঘটায় ভারতবর্ষে। যা শেষপর্যন্ত ভারত বিভক্তি অনিবার্য করে তোলে।