উত্তর : ভূমিকা : হিন্দু শাসনামলের অবসান হয়ে মুসলিম সুলতানদের শাসনের সময়কাল শুরু হয়। হিন্দু শাসকেরা সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করতো, তখন বাংলা ভাষা ছিল অবহেলিত। মুসলিম শাসকগণ ক্ষমতায় এলে বাংলা ভাষাকে মূল্যায়িত করেন। এসময় বাংলা ভাষাভাষী অনেক মুসলিম কবির আবির্ভাব ঘটে। সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম কবিগণ বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু করন। মুসলিম কবি- সাহিত্যিকগণই প্রথম বাংলা ভাষায় লৌকিক কাব্য ও প্রণয়মূলক কাব্য সৃষ্টি করেন। এসময় মুসলিম কবিদের রচনায় ইসলামী চিন্তাধারা ও ঐতিহ্যের প্রকাশ লক্ষ করা যায়। সুলতানি আমলে বাংলায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিতে মুসলিম কবিদের অবদান : সুলতানি আমলে বাংলায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিতে মুসলিম কবিদের ভূমিকা নিম্নে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো :
১. ইতিহাস ও সাহিত্য : সুলতানি আমলে বাংলায় বাংলা ভাষায় ঐতিহাসিক সাহিত্য রচনায় মুসলিম কবি-সাহ্যিকগণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তৎকালীন সময়ে মুসলিম কবিরা ইসলাম ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিজয় কাব্য রচনা করেছেন। মহানবী (স.) ও তার সঙ্গীদের জীবনের বিবিধ স্মরণীয় ঘটনাবলি এবং প্রাথমিক যুগের ইসলামী আন্দোলনের নেতা ও যোদ্ধাদের নিয়ে মুসলিম কবিরা বিজয় কাব্য রচনা করেন। এসকল রচনায় আবেগ, কল্পনা, প্রণয় রসের প্রাধান্য থাকলেও যথেষ্ট ঐতিহাসিক তথ্য ও সন্নিবেশিত ছিল। বাংলা ভাষায় ঐতিহাসিক ঘটনাবিল স্মৃতিচারা করে শেখ জয়জুল্লাহ, “গাজী বিজয়” কাব্য রচনা করেন। এ গ্রন্থে সুলতান বরবক শাহের সেনাপতি শেখ ইসমাইল গাজির কীর্তি কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। অবশেষে বলা যায় যে সুলতানি যুগে মুসলমানদের দ্বারা রচিত বিজয় কাব্যগুলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতির জন্য ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল।
২. বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি সুলতানি আমলে মুসলিম কবি ও সাহিত্যকদের দ্বারা বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। কবি-সাহিত্যিকগণ বহু আরবি, ফারসি শব্দ বাংলার ভাষায় ব্যবহার করেছেন। আল্লাহ, খোদা, নবী, পয়গম্বর, কিতাব প্রভৃতি শব্দ তৎকালীন মুসলিম কবি ও লেখকগণ তাদের.রচনায় লেখার ফলে বাংলার শব্দ ভাণ্ডার পরিপুষ্ট ও সমৃদ্ধ হয়েছে। উপরি উক্ত শব্দগুলো ফার্সি-ভাষার ছিল।
৩. রোমাঞ্চমূলক প্রণয়োপাখ্যান : বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিতে সুলতানি আমলে মুসলমান কবিদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিভাশীল মুসলিম কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর তার ‘ইউসুফ জুলেখা’ রচনা করেন। এটি সাহিত্যের প্রথম প্রণয়কাব্য। এটি
ফার্সি রচনার অনুবাদ, দৌলত উজির ‘লাইলি-মজনু’ প্রেম উপাখ্যান রচনা করেন। সোনা গাজি ‘সাইফ-উল-মূলক’ গ্রন্থটি
রচনা করে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে আরও সমৃদ্ধ করেন। সাহিত্যের অঙ্গণে মুসলমান কবি ও লেখকদের নবতর চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ বাংলা সাহিত্যের গৌরব ও মর্যাদাকে বৃদ্ধি করেছিল ।
৪. কতিপয় কবি-সাহিত্যিকের নাম : বিজয় কাব্য রচয়িতাদের মধ্যে জয়নুদ্দিন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । অন্যান্যদের মধ্যে আছেন- শাহ বদিউদ্দিন, শেখ চাঁদ, নসরুল্লা
খান ও মনসুর প্রভৃতি কবি-সাহিত্যিক।
৫. সংগীত শাস্ত্রে বাংলা ভাষার উন্নতি : সুলতানি আমলে সঙ্গীত সারিত্যও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিকল্পে কাজ করে ।
সংগীত সাহিত্যের গুরুত্বপুর্ণ শাখা। মুসলমানেরা সংগীত সাহিত্য রচনা করতেন। কবি ফয়জুল্লাহর ‘রাগমালা’ বাংলা ভাষায় প্রথম সঙ্গীত বিষয়ক সাহিত্য। মুসলিম কবিরা সাহিত্যে এ ধরনের নতুন.বিষয় প্রবর্তন করে বাংলা কবিদের নিকট একটা দিগন্ত উন্মোচন
করেন এবং ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধির পথকে সুগম করেন।
৬. জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় উন্নতি : বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিতে সুলতান
ি আমলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়ও
অবদান রেখেছিল। কবি মোজাম্মেল ‘নীতিশাস্ত্র বার্তা’ ও ‘সাতনামা’ গ্রন্থ রচনা করেন। এসব গ্রন্থ জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষ শাস্ত্র.সম্পর্কিত গ্রন্থ । বাংলা সাহিত্যের অজ্ঞানে মর্যাদাকে বৃদ্ধি করেছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে ঐকান্তিক চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতিতে
মুসলমানদের শাসকদের পাশাপাশি কবি-সাহিত্যিকদের অবদান তাৎপর্যমণ্ডিত। সুলতানি আমলের শাসকগণই বাংলা ভাষাভাষী বিভিন্ন অঞ্চল ও অধিবাসীদের একত্রিত করেনি, তারা বাংলা ভাষাভিত্তিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যেরও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন