উত্তর : ভূমিকা : মধ্যযুগীয় বাংলায় মুসলিম শাসনের ইতিহাসে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক। সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে এবং দেশের জনগণের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল চিন্তাই তাকে শ্রেষ্ঠ শাসকদের কাতারে প্রথম দিকে স্থান করে দিয়েছে। তিনি শাসক হিসেবে উদার-নীতি গ্রহণের মাধ্যমে সকল ধর্মের মানুষের আস্থা লাভ করতে সক্ষম হন। তার শাসন ব্যবস্থা ছিল প্রজা কল্যাণকামী।
→ হুসেন শাহের রাজ্যবিস্তার : হুসেন শাহ তার শাসনকালে রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে মনোযোগী ছিলেন। তার সুদীর্ঘ রাজত্বকালে সামরিক ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছিলেন। নিম্নে তার রাজ্য বিস্তার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. কামতাপুর-কামরূপ অভিযান : সিংহাসনে আরোহণের এক বছরের মধ্যেই আলাউদ্দিন হুসেন শাহ উত্তরবঙ্গের কামতাপুর রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। কামতাপুর রাজ্য আধুনিক কুচবিহার অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। হুসেন শাহ যে এই অভিযানে সাফল্য লাভ করেন, এ সম্বন্ধে নানা সূত্রেই লেখা আছে। হুসেন শাহের সময়ে এই রাজ্যের রাজা খুব প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। উত্তরবঙ্গের এক বিরাট অঞ্চল এবং আসামের কামরূপ অঞ্চলের তিনি একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন।
২. আসাম অভিযান : কামরূপের পূর্ব ও দক্ষিণে প্রাচীন আসাম বা অহোম রাজ্য অবস্থিত ছিল। এই রাজ্য নিতান্ত দুর্ভেদ্য
ছিল। এখানকার লোকেরা বাইরের কোন লোককে তাদের দেশে প্রবেশ করতে দিত না। রাজ্যটি দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে পরিপূর্ণ
হওয়ার জন্য এবং এখানে বর্ষার প্রকোপ খুব বেশি হওয়ার জন্য এখানকার রাজাদের দেশরক্ষার জন্য বিশেষ বেগ পেতে হত না।
হুসেন শাহ এই অজেয় অহোম রাজ্য জয় করার চেষ্টা করেছিলেন।
কিন্তু তাকে ব্যর্থতা বরণ করতে হয় ।
৩. উড়িষ্যার সাথে যুদ্ধ : উড়িষ্যার রাজা ছিলেন প্রতাপ রুদ্র। বিভিন্ন সূত্রে এ যুদ্ধ সম্পর্কে জানা যায়। হুসেন শাহ দীর্ঘকালব্যাপী উড়িষ্যার সাথে যুদ্ধ করেন। উড়িষ্যার সাথে যুদ্ধ করে তিনি উড়িষ্যাকে কর প্রদানে বাধ্য করান বলে জানা যায়।
৪. ত্রিপুরার সাথে যুদ্ধ : হুসেন শাহের সাথে ত্রিপুরা রাজার ধনমানিক্যের সংঘর্ষ হয়েছিল। ‘রাজমানা’ তে এ যুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। ত্রিপুরার সাথে হুসেন শাহ কয়েকটি পর্যায়ে যুদ্ধ করেছিলেন বলে জানা যায়।
৫. চট্টগ্রামের অধিকার লাভ : চট্টগ্রামের অধিকার নিয়ে হুসেন শাহ আরাকান ও ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
তবে তিনি তাদের বিরুদ্ধে সফল হয়েছিলেন বলে জানা যায়। আরাকান রাজকে এ যুদ্ধে পরাজিত করে বাংলা সামন্তে পরিণত করা হয়।
৬. ত্রিভূত ও বিহারে অভিযান : হুসেন শাহ ত্রিহুত ও বিহারে তার অভিযান প্রেরণ করেছিলেন। তিনি ত্রিহুতের কতকাংশ জয় করেছিলেন। হুসেন শাহ বিহারের অধিকাংশ নিজের রাজ্যভুক্ত করেন। এসব অঞ্চল
নিয়ে তিনি সিকান্দর লোদীর সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেছিলেন।
৭. মূল্যায়ন : হুসেন শাহ কামতাপুরের খেন রাজ্য ধ্বংস করেছিলেন। উড়িষ্যা ও ত্রিপুরা রাজ্যের কিয়দংশ অধিকার • করেন, উত্তর বিহার ও দক্ষিণ বিহারের অংশ বিশেষে ও তার আধিপত্য ছিল। চট্টগ্রাম অধিকার নিয়ে আরাকান ও ত্রিপুরা রাজ্যের বিরুদ্ধেও তিনি সাফল্য লাভ করেছিলেন। বাংলার স্বাধীন
সুলতানি আমলে তার রাজত্বকালেই বাংলার মুসলিম রাজ্যের শৌর্যবীর্যের সর্বাপেক্ষা অধিক উদ্যম প্রকাশ পেয়েছিলেন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, হুসেন শাহ তার সুদীর্ঘ রাজত্বকালে সামরিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছিলেন। দীর্ঘ সাফল্যজনক রাজত্বের পর আলাউদ্দিন হুসেন শাহের মৃত্যু
হয়। ১৪৯৩-১৫১৯ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৬ বছর তিনি রাজত্ব করেছিলেন। তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল বলে জানা যায়।