উত্তর : ভূমিকা : বাংলার ইতিহাসে সেন রাজবংশের শাসন একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। একাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায়
সেন রাজবংশের উদ্ভব হয়। উত্তর বাংলায় সামন্তচক্রের বিদ্রোহের সময় পাল সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ সেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সেন ধীরে ধীরে নিজ ক্ষমতার
উন্নতি সাধন করেন। বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম সমগ্র বাংলায় একক স্বাধীন রাজত্বের প্রতিষ্ঠা হয় সেন রাজবংশের শাসনাধীনেই। এ বংশের শাসকগণ প্রথমদিকে যথেষ্ট কৃতিত্বের সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করলেও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, শ্রেণি সংঘাত, তুর্কি আক্রমণ প্রভৃতি কারণে এ বংশের পতন ঘটে।
→ সেন বংশের শাসনের অবসানের কারণ : শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, শ্রেণি সংঘাত ও তুর্কি আক্রমণেই বাংলায় সেন বংশের শাসনের অবসান ঘটেনি। এর সাথে আরো নানাবিধ কারণ ছিল। নিম্নে সেন বংশের শাসন অবসানের কারণগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ
১. প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা : ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রশাসনের সকল স্তর সেনরা দখল করেছিল। কিন্তু শ্রেণিগত নিয়োগের ফলে প্রশাসনব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার ফলে প্রাদেশিক শাসনকাঠামো একেবারে ভেঙ্গে পড়ে।
২. সময়ের বিবর্তন : ঐতিহাসিক ইবনে খালদুনের মতে, কোনো রাজবংশের স্বাভাবিক সময়কাল এক’শ বছর। এসময়ের | মধ্যেই সেই রাজবংশের উত্থান, উন্নতির শিখরে উঠা ও পতন । মোটামুটি সম্পন্ন হয়। জগতে কোনো রাজবংশই চিরস্থায়ী হয়নি। গৌরবের এক পর্যায়ে তার পতন অনিবার্য। বাংলায় সেন
রাজবংশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
৩. বর্ণবৈষম্য : সেনযুগে বাংলায় ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, গন্ধবণিক শূদ্র, বৈশ্য, ক্ষত্রিয় প্রভৃতি বর্ণপ্রথা প্রচলিত ছিল। আত্মস্বার্থকে
কেন্দ্র করে এসব শ্রেণির মধ্যে দেখা দেয় শ্রেণিসংঘাত। বর্ণবৈষম্য সেনযুগে প্রকট আকার ধারণ করেছিল। এ বর্ণবৈষম্য কেন্দ্রীয় শাসনকে দুর্বল করে দেয়।
৪. সামরিক দুর্বলতা : লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বের শেষ পর্যায়ে তাদের সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। অভ্যন্তরীণ নানা বিশৃঙ্খলার
কারণে সেনাবাহিনীর ঐক্য বিনষ্ট হয়েছিল। মূলত বৈদেশিক আক্রমণ ঠেকানোর মতো সামরিক শক্তি সেন সাম্রাজ্যে ছিল না।
৫. অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ : সেন রাজবংশের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ। সেন রাজবংশের শাসনের শেষের দিকে সেন সাম্রাজ্য অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে এবং স্থানীয় সামন্তরা দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। রাজত্বের শেষে লক্ষ্মণ সেনের দুর্বলতার কারণে শাসনতন্ত্র হয়ে
পড়ে নেতৃত্বহীন। এ সুযোগে বিভিন্ন প্রদেশে সামন্ত রাজাদের মধ্যে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে.
৬. শাসক ও শাসিতের মধ্যকার দূরত্ব : সেন আমলে সমাজে প্রধানত চারটি শ্রেণি বসবাস করতো। তারা ছিল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। উচ্চবর্ণের সাথে নিম্নবর্ণের লোকদের
বৈবাহিক সম্পর্ক, সামাজিক সম্পর্ক ও অন্যান্য মেলামেশা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সমাজের সিংহভাগ অধিবাসী ছিল নিম্নবর্ণের।
শাসনকার্যে তাদের মোটেই কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। নিম্নবর্ণের লোকদের শিক্ষাগ্রহণেরও কোনো সুযোগ ছিল না। স্বভাবতই এ
শাসনব্যবস্থায় নিম্নবর্ণের মানুষেরা সুবিচার পেত না। এসব সমস্যার কারণে শাসক ও শাসিতের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পায়।
৭. পরধর্মে অসহিষ্ণুতা: সেনবংশের শাসকগণ পরধর্মের প্রতি ছিলেন চরম অসহিষ্ণুতা। সেনরা প্রথমে পাল রাজাদের অধীনে উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত ছিলেন। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পালরা ছিলেন অত্যধিক উদার। কিন্তু সেনরা বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পালদের ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের উপর চরম অত্যাচার ও নির্যাতন শুরু করে। সেনদের এ ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ব
িক্ষুদ্ধ করে তোলে যা সেন
বংশের পতনে বিশেষ সহায়তা করে।
৮. তুর্কি আক্রমণ : বাংলায় সেন বংশের শাসনের অবসানের প্রধান ও প্রত্যক্ষ কারণ ছিল তুর্কিদের বাংলা আক্রমণ। তুর্কি বীর বখতিয়ার খলজি ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে বিহার
অধিকার করেন। পরের বছর তিনি বাংলা আক্রমণ করেন। লক্ষ্মণ সেন বাংলায় প্রবেশ করার স্বাভাবিক পথ তেলিয়াগড়ের
গিরিপথে সৈন্য মোতায়েন করেছিলেন। কিন্তু বখতিয়ার খলজি ঝাড়খন্ডের জঙ্গল দিয়ে তার বাহিনী নিয়ে নদীয়া পৌঁছেন এবং
তা দখল করেন। লক্ষ্মণ সেন তুর্কি আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা না করে পালিয়ে নৌপথে বিক্রমপুরে গিয়ে আশ্রয় নেন। মূলত
। এর মধ্যদিয়েই বাংলায় সেন বংশের শাসনের অবসান ঘটে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সেন রাজবংশ ছিল বাংলার শেষ শক্তিশালী হিন্দু রাজবংশ। পাল বংশের পতনের পর সেন বংশ বাংলায় কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল এবং দক্ষতার
সাথে বাংলা শাসন করেছিল। কিন্তু লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালের ৷ শেষদিকে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, বিশৃঙ্খলা, প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বিদ্রোহ এবং সর্বোপরি তুর্কি আক্রমণের ফলে বাংলায় সেন রাজবংশের পতন ঘটে ।


