উত্তর : ভূমিকা : ইতিহাস লেখার অন্যান্য উৎসের মত বিদেশি পর্যটকদের বর্ণনাও গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস। প্রাচীনকাল হতেই ভারতীয় উপমহাদেশে নানা দেশ থেকে পর্যটক আসতো। সেই সুবাদে বাংলায়ও আসতো। পর্যটকেরা সর্বত্র ভ্রমণ করে তার মনোজ্ঞ বিবরণ রেখে যেতেন। এ ধারণানুসারে মধ্যযুগে বাংলায় অনেক পর্যটক আসতো।
এরা বাংলা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রেখে যান। মধ্যযুগে বাংলা সম্পর্কে বিশেষ কোন উপাদান পাওয়া যায়না। এক্ষেত্রে প্রায় প্রতিটা উৎসকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাস রচনায় বিদেশি পর্যটকদের বর্ণনা নিয়ে আলোচনা করা হলো।
জ →বিদেশি পর্যটকদের বিবরণে মধ্যযুগীয় বাংলা : বাংলা তথা দর ভারতীয় উপমহাদেশে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে
পর্যটকেরা এসেছেন। ভারতে এসে তারা অনেকে বাংলায়ও ভ্রমণ করতে এসেছেন। বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে মরক্কোর মুসলমান
পর্যটক ইবনে বতুতা সুলতানি আমলে প্রথম বাংলায় আগমন করেন। ১৩৩৩ সালে দিল্লি সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের ↑র্ণ | রাজত্বকালে দিল্লি আসেন। চীন যাওয়ার পথে ১৩৪৬ সালে বাংলা ভ্রমণ করেন। তিনি সমুদ্র পথে আসেন এবং সোদকাওয়ান (চট্টগ্রামের অভিন্ন মনে করা হয়) বন্দরের ভেতর দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন এবং সেখান থেকে সিলেটে গিয়ে শাহজালালের সাথে সাক্ষাত করেন। এখানে আসার পর তিনি ‘রেহালা’ নামে একটি সফরনামা রচনা করেন। যেখানে বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়। সোনারগাঁও বাজারে প্রাপ্ত বিভিন্ন পণ্যের মূল্যের উল্লেখ করেন ইবনে বতুতা।
তিনি সুফি ও তাদের অনুসারীদের সাথে সাক্ষাত করেছেন এবং তাদের খানকায় বসবাসের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে ধারণা নেন। তিনি
ঐ | সমকলীন মুসলিম শাসকের শাসনকাল বর্ণনা করেছেন। তার লেখা হতে বাংলার মুসলিমদের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে জানা যায়।
→ চীনা পর্যটক : বাংলার বিখ্যাত সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের শাসনামলে ও তার পরেও চীনা দূত বাংলা সফর করেন। এসব চীনা দূতদের বর্ণনা হতে বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা জানা যায়।
১. মাহুয়ান : ১৪২৫-১৪৩২ সালের দিকে তিনি বাংলায় আসেন ও বাংলার সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে রচনা করেন।
২. ফি-সিন (Fei-sin) : ফি-সিন-এর বিবরণেও বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। (১৪৩৬ সাল)
৩. হুয়ান সিঙ্গ সেন : ১৫২০ সালে হুয়ান সিঙ্গ সেন বাংলায় আসেন। তিনি বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার আলোচনা
ছাড়াও এই বিবরণে সুলতানের নাম উল্লেখ করেন এবং ১৪৩৮ সাল পর্যন্ত বাংলার সুলতান কর্তৃক চীন দেশে দূত বিনিময়ের কথা বলেছেন ।
৪. ইয়েন সংকিয়েন : ১৫৭৪ সালে ইয়েন সংকিয়েন বাংলায় আসেন। তিনি বলেন, “This is the most compelete of all accounts, based not only on the previous accounts but also on their sources not known to us at present”
→ ইউরোপীয় পর্যটক : ইউরোপের ভ্রমণকারীগণ বাংলায় এসেছেন ষোল শতকের কিছু সময় আগে ও ষোলো শতকের গোড়ার দিকে। পর্যটকেরা এদেশে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যেই বেশি আসতো। তাই তাদের বর্ণনায় বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ই বেশী থাকতো। তবে তারা মাঝে মাঝে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা
সম্পর্কেও আলোকপাত করতেন। নিকোলো-দি-কান্ট, ভাস্কো-দা- গামা, ভারথেমা, বারবোসা, জোয়াও ডি বেরস, সিজার ফ্রেডারিক ও তোমে পিরেস উল্লেখযোগ্য ইউরোপীয়ান পর্যটক।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এদেশে আসা বিদেশি পর্যটকদের লেখনী বা সাহিত্যের গুরুত্ব
অস্বীকার করা যায় না। তাদের বর্ণনা হতে আমরা বহুমূল্যবান তথ্য পেয়েছি। তারা বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক প্রভৃতি বিষয়ে মূল্যবান আলোচনা রেখে গেছেন।