বাংলায় মুঘল শাসনের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বী’-র ভূমিকা আলোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে (১৬০৫-১৬২৭ খ্রিঃ) সুবেদার ইসলাম খাঁর রণকৌশলে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। অবশেষে ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজুদ্দৌলার
পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলায় মুঘলদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শাসনের অবসান হয়। প্রায় দীর্ঘ পৌনে দুইশত বছর বাংলা মুঘল শাসনাধীন
ছিল। এ দীর্ঘ সময়ে বাংলার শাসনতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক জীবন যাত্রার গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করতে গিয়ে
ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্য তথ্যের অপ্রতুলতাজনিত সমস্যার সম্মুখীন হন। দিল্লির অধীনে বাংলা ছিল একটি সুবা মাত্র। দিল্লির শাসনকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে ও পৃষ্ঠপোষকতায় যে ঐতিহাসিক রচনা
হয়েছিল তাতে বাংলার উল্লেখ আছে কিঞ্চিত পরিমাণ। তাই বাংলার ইতিহাস জানা সহজসাধ্য নয়। তথাপি মির্জা নাথানের ‘বাহারিস্তান-ই- গায়বী’ তার ব্যতিক্রম। নিম্নে মির্জা নাথানের ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বী
আলোকে বাংলার অবস্থা বর্ণনা করা হলো :
→ বাংলায় মুঘল শাসনের ইতিহাস রচনার উৎস হিসেবে বাহারিস্তান-ই-গায়বী : বাংলায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে সংগঠিত সেই যুদ্ধ-বিগ্রহ দেশিয় স্বাধীনচেতা জমিদার ও
রাজন্যবর্গের প্রচেষ্টা ইত্যাকার প্রয়োজনীয় বিষয়ের বাস্তব তথ্য সম্বলিত বিবরণ হলো মির্জা নাথানের ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বী’।
১৬০৮-১৬২৪ খ্রিঃ পর্যন্ত বাংলার বারো-ভূঁইয়াদের মুঘল বিরোধিতা ও প্রতিরোধ, বাংলার প্রতি মুঘল আমলাতন্ত্রের মনোভাব, বাংলা-বিহার-কুচবিহার-উড়িষ্যাৎ-কামরূপ
এলাকার জনগণের দিন যাপনের এবং সমকালীন রাজন্যবর্গের রণকৌশল প্রভৃতি বিষয়ে এ গ্রন্থটি একটি প্রামাণ্য দলিল। ১৬০৮-
১৬২৪ খ্রিঃ পর্যন্ত এই ১৬ বছর তিনি বাংলার স্বাধীনচেতা বিদ্রোহী জমিদার ও রাজন্যবর্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বসেই
তিনি এগ্রন্থটি রচনা করেন। তার রচনায় দীর্ঘ ১৬ বছরের যাবতীয় ঘটনাবলির ধারাবাহিক আনুপূর্বিক বিবরণ পাওয়া যায় । প্রভৃতি
→ বাহারিস্তান-ই-গায়বীর শ্রেণিবিন্যাস : ‘বাহারিস্তান-ই- গায়বী’ গ্রন্থটিকে চারটি দফতরে বা চার খণ্ডে ভাগ করে লেখা
হয়। প্রত্যেকটি দফতর সমকালীন এক একজন মুঘল সুবেদারের শাসনকাল ও ঘটনাবলির বিবরণ সম্বলিত। যথা-
→ গঠন কাঠামো :
১. ইসলাম নামাহ : ইসলাম খানের সুবেদারী সম্পর্কিত ইতিহাস;
২. কাশিম নামাহ : কাশিম খান সম্পর্কিত ইতিহাস;
৩. ইব্রাহীম নামাহ : ইব্রাহীম খানের শাসনকাল বিষয়ক ও
৪. ওয়াকাত-ই-জাহান : শাহজাহানের বিদ্রোহ ও বাংলা, উড়িষ্যার শাসনভার দখল সম্পর্কিত বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ :
→ বিষয়বস্তু : প্রথম দফতরকে আবার ১২টি দস্তানে ভাগ করা হয়। ১১টি দস্তানেই বাংলা সম্পর্কিত আলোচনা আছে।
১৬০৭-১৬১৩ খ্রিঃ ইসলাম খানের সুবেদারিতে নিযুক্ত হতে মৃত্যু পর্যন্ত বর্ণনা করা আছে। এগুলোতে বর্ণিত আছে মুসা খান, খাজা
উসমান, প্রমুখ বার ভূঁইয়াদের সাথে ইসলাম খানের সম্মুখ যুদ্ধ, ভাটি, যশোর,বাকুলা প্রভৃতি এলাকা দখলের ইতিহাস ।
দ্বিতীয় দফতরে ৮টি দস্তানের মধ্যে ৩টিতে বাংলা সম্পর্কে আলোচনা আছে। বাংলার প্রশাসনিক রদবদল, কাশিম খানকে
বাংলায় নিয়োগ-অপসারণ পর্যন্ত সময়ের বিবরণ এ দস্তানে আছে। চতুর্থ দফতরে শাহজাহানের বিদ্রোহের বিষয়ে লেখা।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলার ইতিহাস রচনায় মির্জা নাথানের ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বী’ অত্যন্ত মূল্যবান একটি উৎস। বাহারিস্তানের গঠন কাঠামো ও বিষয়বস্তু বিচার করবে বোঝা যায় বাংলার বারো ভূঁইয়াদের সাথে মুঘলদের সংঘর্ষের
প্রত্যক্ষ দলিল হিসেবে এই গ্রন্থ কতটা মূল্যবান। সুতরাং, বাংলার বারো ভূঁইয়াদের সম্পর্কে প্রকৃত ইতিহাস জানতে হলে এ গ্রন্থটির বিকল্প নাই। এ গ্রন্থটি অনেকটা ত্রুটিমুক্ত লেখা।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a5%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ae%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%af%e0%a7%81%e0%a6%97%e0%a7%87-%e0%a6%ac/