উত্তর ভূমিকা : মানুষ সৃষ্টির ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, প্রতিটি মানুষ একটি প্রতিকূল পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে। প্রতিকূলতা ও বৈরী পরিবেশের মধ্য দিয়েই সে ধীরে ধীরে বড় হয় এবং স্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু সমাজ পরিবেশের বিভিন্ন বিপদাপদ ও দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা যেমন- বেকারত্ব, দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানব জীবনে অনিশ্চয়তা ও বিপর্যয় ডেকে জানে। তাই এসব প্রতিকূল অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হবে।
সামাজিক নিরাপত্তা : সাধারণত, আধুনিক শিল্প সমাজের অসুস্থতা, বেকারত্ব, বার্ধক্যজনিত নির্ভরশীলতা, পেশাগত দুর্ঘটনা, অকাল মৃত্যু প্রভৃতি মানুষের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার বহির্ভূত আকস্মিক আর্থিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সামাজিক প্রতিরক্ষামূলক কর্মসূচিই সামাজিক নিরাপত্তা।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা:
Couins Dictionary Sociology গ্রন্থের ব্যাখ্যানুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তা হলোঃ “Social Security is a system
of income maintenance proved by the state.” সামাজিক নিরাপত্তার ব্যাখ্যায় William Beveridge বলেছেন। সামাজিক নিরাপত্তা হলো অভাব, রোগ, অজ্ঞতা,
মলিনতা ও অসুস্থতা একটি দৈত্যের প্রতিরক্ষায় ব্যবস্থা করা।
W.A. Fried lander এর মতে, Social security is a programe of protection against sickness, Unemployment Death of eam, old age or disability etc.
সমাজকর্ম অভিধান অনুযায়ী, সামাজিক নিরাপত্তা হচ্ছে সেই ব্যবস্থা যার মাধ্যমে আইনগত স্বীকৃত বিপত্তি যেমন বৃদ্ধাবস্থা,
অসুস্থতা, অপরিপক্কতা কিংবা বেকারত্বের কারণে উপার্জনহীন নাগরিকদের জন্য আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়। সার্বিকভাবে বলা যায় যে, মানুষের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার বাইরে বেকারত্ব, বার্ধক্য ও মৃত্যু ইত্যাদি দৈব ঘটনা মোকাবিলা করার জন্য সামাজিক আইনের মাধ্যমে যে আর্থিক সেবা প্রদান করা হয়, তাকে সামাজিক নিরাপত্তা বলে।
― নিম্নে সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচিসমূহ আলোচনা করা হলো ঃ
১. সামাজিক বিমা ঃ ILO তথা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এর সুপারিশমে কর্মচারীর কল্যাণে ১৯৬২ সালে বিমা ব্যবস্থার অনুমোদন হয়। সামাজিক বিমা সম্পর্কে R.C.Saxena বলেন- সামাজিক রিমা হলো এমন একটি পদ্ধতি যা
ব্যক্তিকে দারিদ্র্য ও দুর্দশায় নিক্ষিপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে এবং জরুরি সময়ে রক্ষা করে এই আইন অনুযায়ী মাতৃত্ব সুবিধা, কর্মচারী দুর্ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতি সুবিধা দেওয়ার বিধান চালু করা হয়।
২. সামাজিক সাহায্য : সামাজিক সাহায্য সমাজে অক্ষম, দুর্বল, অসহায়, বর্ধিত, আকস্মিক দুর্ঘটনা কবলিত এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত মানুষের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৩. সমাজসেবা : সমাজসেবা বলতে যেসব সংঘটিত কার্যাবলির সমষ্টিকে বুঝায় সেগুলো প্রাথমিক ও প্রত্যক্ষভাবে মানব সম্পদ উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও প্রতিরোধের সাথে সম্পৃক্ত। সমাজসেবামূলক কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শিক্ষা, শিশুকল্যাণ, পরিবার কল্যাণ, নারীকল্যাণ, শ্রমকল্যাণ, যুবকল্যাণ, সংশোধনমূলক কার্যম, মানসিক স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য প্রভৃতি।
৪. মাতৃত্ব সুবিধা ঃ বাংলাদেশে ১৯৪১ ও ১৯৫০ সালের মাতৃকল্যাণ আইন বলবৎ রয়েছে। এসব আইনে প্রণীত মাতৃত্বকল্যাণের আইনের আওতায় মহিলাদের বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করছে। সন্তান জন্মদানের আগে ও পরে ৬ সপ্তাহ হতে ১২ সপ্তাহ বেতনসহ ছুটি প্রদান। বর্তমানে ছুটি ৪ মাস করা হয়েছে।
৫. যৌথ বিমা : ১৯৫৯ সালে প্রণীত Group Insurance act অনুসারে বাংলাদেশের সব মেয়াদ ও মূল বেতন অনুপাতে আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকে। অবসরকালীন সময়ে পেনশনের সাথে এ তহবিলের সমুদয় অর্থ প্রদান করা হয়।
৬. জীবন বিমা ঃ এ কর্মসূচির অধীনে যে-কোনো ব্যক্তি নিজের জীবনের নিরাপত্তার জন্য বিমা করে থাকে। বিমাকারী ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে বিমার নির্দিষ্ট মেয়াদ পূর্তির আগেই তার পরিবার বিমাকৃত সমুদয় অর্থ ফেরত পায় আবার পঙ্গুত্ব বরণ করলেও ক্ষতিপূরণ পেয়ে থাকে
।
৭. বয়স্কভাতা : বাংলাদেশে ১৯৯৭-৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বয়স্কভাতা কার্যম শুরু করে। শুরুতে ১০০ টাকা করে দেওয়া হলেও বর্তমানে ৩০০ টাকা করে জনপ্রতি প্রদান করা হয়।
৮. বিধবাভাতা ঃ বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৮ সাল হতে বিধবা ভাতার প্রচলন করে। এ ক্ষেত্রে তালাক প্রাপ্তা, পরিত্যক্তা, দুঃস্থ, অসহায় মহিলারা অন্তর্ভুক্ত। ২০০৩-০৪ অর্থবছর হতে ভাতার পরিমাণ ১৫০ টাকা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সব সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মচারীদের যৌথ বিমার আওতাভুক্ত করা হয়েছে। চাকরিরত অবস্থায় কোনো কর্মচারীর মৃত্যু হলে, তার পরিবার সরকারি কর্মচারী যৌথ বিমার অধীনে আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকে ।
৯. পেনশন ঃ সরকারি কর্মচারীদের চাকরি হতে অবসর গ্রহণের পর নির্দিষ্ট অবসর ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে এছাড়া নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে পেনশনসহ স্বেচ্ছায় চাকরি হতে অবসর গ্রহণের সুবিধা বাংলাদেশে রয়েছে। ২০০২ সাল হতে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
১০. প্রভিডেন্ট ফান্ড ঃ ১৯২৩ সালের প্রভিডেন্ট ফান্ড আইনের অধীনে সরকারি কর্মচারীদের মূল বেতন হতে নির্দিষ্ট হারে ভবিষ্যৎ তহবিলে দান বাধ্যতামূলক। চাকরিরত সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী এ তহবিল হতে অগ্রিম টাকা উঠাতে পারে।
১১. কর্মচারী কল্যাণ তহবিল ঃ এ ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের মূল বেতন হতে প্রতিমাসে নির্দিষ্ট হারে এ তহবিলে জমা দিতে হয়। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের তহবিলের চাঁদা সরকার নিে বহন করে। চাকরিতে থাকা অবস্থায় কোনো কর্মচারীর মৃত্যু হলে ও তহবিল হতে তার পরিবার চাকরির সমুদয় টাকা ভাতাদিসহ ফেরত পায়।
১২. গৃহায়ন তহবিল ঃ বাংলাদেশ সরকার দরিদ্র, অসহায় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আশ্রয়হীন হওয়া মানুষের জন্য আর্থিক অনুদান দিতে গৃহায়ন তহবিল গঠন করে।
১৩. কর্মসংস্থান ব্যাংক : বাংলাদেশের বেকার যুবক যুবতীদের লাভজনক ও উৎপাদনমুখী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে তাদেরকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কর্মসংস্থান ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৪. ক্ষুদ্রঋণ কার্যম : ভূমিহীন, অসহায় মানুষের জন্য মূলধন সৃষ্টির লক্ষ্যে ক্ষুদ্রঋণ কার্যম চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশে বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারি ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে।
উপসংহার ঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সামাজিক নিরাপত্তা হচ্ছে সমাজের অসুবিধাগ্রস্ত ও বিপদগ্রস্তু বিশেষ বিশেষ
শ্রেণির সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গৃহীত প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা। যার সমর্থনে অধিকাংশ ক্ষেত্রের সামাজিক আইনগত সহায়তার প্রয়োজন হয়। মূলত দ্রুত পরিবর্তনশীল শিল্পায়িত ও উন্নত প্রযুক্তির জটিল সমাজ ব্যবস্থায় অসুস্থতা, বেকারত্ব,
দরিদ্র্যতা ও উপার্জন অক্ষমতা, দুর্ঘটনা ও অন্যান্য বিপদাপদের কারণে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়।