রেডক্রস/ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির পরিচয় দাও।

উত্তর ঃ ভূমিকা ঃ বিশ্বের যে সকল প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে আর্তমানবতার কল্যাণে নিয়োজিত রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি তাদের মধ্যে অন্যতম। সুইজারল্যান্ডের অধিবাসী হেনরি ডুনান্ট নামক এক মানবদরদি দুর্গত মানুষের সেবার জন্য এটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুঃস্থ, পীড়িত, অসহায়, বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠির অবস্থার উন্নয়নে নিরলস প্রচেষ্টা
চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত ঃ মুসলিম বিশ্বে ত্রাণ, পুনর্বাসন ও মানবিক সাহায্য পরিচালনায় নিয়োজিত রেড ক্রিসেন্ট আন্ত র্জাতিক রেড ক্রসের ভিন্ন একটি নাম। মানবতার সেবায় অগ্রদূত রেড ক্রিসেন্টের আন্তর্জাতিক রেডক্রসের ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
১. রেড ক্রস/রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ৪ ১৮৫৯ সালে উত্তর ইতালির সলফেরিনো নামক স্থানে ফরাসি সৈন্যদের সাথে ইতালীয় ও অস্ট্রীয় সৈন্যদের মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধে ৪০,০০০ এরও বেশি লোক হতাহত হয়। এ চিত্র দেখে
তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। এমন অবস্থায় যুদ্ধে আহত সৈন্যদের সেবাশুশ্রুষার জন্য আশেপাশের গ্রামের লোকজনকে নিয়ে তিনি একটি স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করেন এবং তাদের পরিচর্যা করার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলতে সক্ষম হন। তার এ অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখেই ১৮৬৩ সালে জন্ম হয় একটি মানবসেবামূলক সংস্থা ‘রেডক্রস সমিতি।’ ১৯১৯ সালে ৬০টির মত জাতীয় রেডক্রস সোসাইটির সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘লীগ অব রেডক্রস সোসাইটিজ’ এর উদ্দেশ্য হলো দুর্যোগ ও ত্রাণকার্য পরিচালনা, প্রাকৃতিক ও মানবিক দুর্যোগে ত্রাণ বিতরণ ও ত্রাণ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দান। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় তুর্কী সুলতান খ্রিস্টানদের প্রতি বিরোধিতার প্রশ্নে রেডক্রিসের পরিবর্তে রেডক্রিসেন্ট নাম ব্যবহার করতে থাকেন। এরপর থেকে অধিকাংশ মুসলিম দেশ রেডক্রসের পরিবর্তে রেডক্রিসেন্ট নাম ও প্রতীক ব্যবহার করতে থাকেন। আন্ত র্জাতিক রেডক্রস সংস্থা কর্তৃক রেড ক্রিসেন্ট অনুমোদিত হয়।
২. রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্টের জন্ম ও ইতিহাস/পটভূমি ঃ ১৮৫৯ সালের ২৪ জুন ইতালির উত্তরাঞ্চলের পল্লি প্রান্তর সালফেরিনো নামক স্থানে ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে মানব ইতিহাসের এক ভয়াবহ মারাত্মক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ১৬ ঘণ্টাব্যাপী এ যুদ্ধে প্রায় ৪০,০০০ সৈন্য হতাহত হয়। আহত সৈন্যরা বিনা চিকিৎসায় যুদ্ধক্ষেত্রেই উন্মুক্ত প্রান্তরে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। সেই সময় সুইজারল্যান্ডের এক যুবক জী হেনরি ডুনান্ট (Jean Henri
Dunant) ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে ফ্রান্সের ৩য় নেপোলিয়ানের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছিলেন। যুদ্ধ পরবর্তী মর্মান্তিক করুণ ও ভয়াবহ দৃশ্য দেখে তিনি ব্যথিত হন এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রের এই মর্মান্তিক দৃশ্য তাকে অত্যন্ত বিচলিত করে তোলে। তিনি আহত সৈন্যদের সেবা প্রদানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে ও অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে ছুটে যান পার্শ্ববর্তী গ্রামে তিনি গ্রামবাসী ও সেখানকার গীর্জার পুরোহিত এবং সেবাদাতাদের কাছে আহতদের সেবায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। আবেদনে সাড়া দিয়ে গ্রামবাসী, বিশেষ করে মহিলারা এগিয়ে আসেন এবং তাৎক্ষণিক সেবা ও প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অনেকের জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরাই রেডক্রসের প্রথম স্বেচ্ছাসেবক যাদের অধিকাংশ ছিলেন মহিলা। ডুনান্ট এ যুদ্ধের ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় স্মৃতিও তার প্রতিকারের জন্য ১৮৬২ সালে “A Memory of
Seferino” নামে একটি বই রচনা করেন যার মাধ্যমে তিনি বিশ্ববাসীর প্রতি এক মানবিক আবেদন জানান বইটির মূল কথা ছিল। “আমরা কি পারি না প্রতিটি দেশে একটি সেবামূলক সংস্থা গঠন করতে, যারা শত্রুমিত্র নির্বিশেষে আহতদের সেবা করবে।” সে সময়ে জেনেভায় একটি সমাজসেবা সংগঠন “পাবলিক ওয়েল ফেয়ার সোসাইটি’ সর্বপ্রথম ডুমান্টের আবেদনে সাড়া দেয়। ১৮৬৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জীন হেনরি ডুনান্ট ৪ জন জেনেভাবাসীকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন
করেন যা “Committee of Five.” নামে পরিচিত। কমিটির সকল সদস্যই ছিলেন সুইস নাগরিক। প্রাথমিক নামকরণ করা হয় International Committee for Relief to the Initiatary wounded পরবর্তীতে এ কমিটির নাম পরিবর্তিত হয়ে “International committee of the Red cross.” বা ICRC হয়। একই বছর ২৬ অক্টোবর প্রথমবারের মত এ কমিটি ১৬টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে জেনেভায় আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করে। সম্মেলনে ডুনান্টের মহতী প্রস্তাবগুলো
পর্যালোচনা ও গৃহীত হয় এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে রেডক্রস জন্মলাভ করে। আর এর প্রতীক সুইজারল্যান্ডের জাতীয় পতাকার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়। যুদ্ধে লিপ্ত দেশগুলোর মধ্যে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে আস্ত র্জাতিক রেডক্রস। ১৯৯৯ সালে ৫০টির মত জাতীয় রেডক্রস সোসাইটির সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘লীগ অব রেডক্রস সোসাইটিজ’। এর উদ্দেশ্য হলো দুর্যোগ ও ত্রাণ কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় সাধন তহবিল গঠন, জরুরি ত্রাণ কার্য পরিচালনা, প্রাকৃতিক ও মানবিক দুর্যোগে ত্রাণ বিতরণ ও ত্রাণ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দান। উল্লেখ্য, রেডক্রসের প্রতিষ্ঠাতা
হেনরি, ডুনান্ট ১৯০১ সালে ১ম শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুর্কি সুলতান খ্রিস্টানদের প্রতি বিরোধিতার প্রশ্নে রেডক্রসের পরিবর্তে রেডক্রিসেন্ট নাম ব্যবহার করতে থাকেন। রেডক্রিসেন্ট শব্দটি মূলতঃ মুসলমান ও খ্রিস্টানদের বৈরিতার প্রেক্ষাপটে সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে অধিকাংশ মুসলিম দেশ রেডক্রসের পরিবর্তে রেডক্রিসেন্ট নাম ও প্রতীক ব্যবহার করতে থাকেন। ১৮৭৬ সালে রুশ-তুর্কি যুদ্ধের সময় অটোমান সাম্রাজ্যে রেডক্রসের পরিবর্তে রেডক্রিসেন্ট ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। মিশরও রেডক্রিসেন্ট ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯২৯ সালের কনভেনশনে এসব প্রতীক লিখিতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৮২ সালে রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট
সোসাইটিসমূহের আন্তর্জাতিক ফেডারেশন তাদের প্রতীক হিসেবে সাদা জমিনে রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট একাত্রে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। বর্তমানে রেডক্রিসেন্ট আন্তর্জাতিক রেডক্রস সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত।
উপসংহার ঃ পরিশেষে বলা যায় যে, মানব কল্যাণমূলক সংস্থা হিসেবে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির ইতিহাস এক বিরাট ইতিহাস। এটি শুরু হয়েছিল মূলতঃ যুদ্ধে হতাহত সৈন্যদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠাতা হেনরি ডুনান্ট এর উদ্যোগে কমিটি গঠন করেন এবং সারা বিশ্বে তাদের সেবা পৌছিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করতে থাকেন।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই রেডক্রিসেন্ট তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।