International labour Organization বলতে কি বুঝ? আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) -এর কার্যগুলো কি কি?

উত্তর। ভূমিকা ঃ বিশ্বের অন্যতম পুরাতন এবং জাতিসংঘের সর্বাপেক্ষা পুরনো সংস্থা হচ্ছে International labour Organization শ্রমিকরা পূর্বে নানা রকম সমস্যায় জর্জরিত ছিল। শ্রমিকদের সেই সকল সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য গঠিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা। এ সংস্থাটি শ্রমিকদের অধিকার আদায় শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও জীবনমান উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। যে সকল শ্রমিকরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে এ সংস্থাটি নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
→ International labour Organization : জাতিসংঘের একটি বিশেষ সংস্থা হলো আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা International Labour Organization (ILO)। ভার্সাই চুক্তির অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে ১৯১৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা গড়া হয়। এ সংস্থাটি লীগ অব নেশনস এর সাথে সম্পৃক্ত ছিল। জাতিসংঘের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য কানাডার মনট্রিলে ১৯৪৬ সালের ৯ অক্টোবর একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। ২০ এপ্রিল, ১৯৪৮ এই চুক্তি বলবৎ হয় ও চুক্তির শর্তাদি সাধারণ পরিষদ অনুমোদন করে ১৯৪৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর তারিখে। ফলে জাতিসংঘের
বিশেষ সংস্থা হবার গৌরব অর্জন করে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা। “শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ, অধিকার আদায়, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, জীবনমান উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা আনয়নে বিশ্বব্যাপী যে সংস্থাটি কাজ করছে তাকেই International Labour Organization (ILO) বলে।”
→ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কার্যাবলি ভূমিকা ঃ বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ১৮৯টি দেশ বর্তমানে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ILO বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে যে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো ঃ
১. পূর্ণ কর্মসংস্থান ও কর্মপরিবেশ সৃষ্টিতে ঃ ILo শ্রমিকদের জন্য পূর্ণকর্মসংস্থান, কাজের শর্ত, বেকারত্ব দূরীকরণ, বয়স নির্ধারণ, বেতন কাঠামো নির্ধারণ, সময়সীমা নির্ধারণ, কর্ম পরিবেশ তৈরী, PIACT ইত্যাদি নির্ধারণ করে থাকে। যা শ্রমিকদের জন্য বিশেষ উপযোগী। সুতরাং বলা যায় শ্রমিকদের জন্য পূর্ণ কর্মসংস্থান ও কর্ম পরিবেশ তৈরিতে ILO
ব্যাপক ভূমিকা রাখে ।
২. নীতিমালা প্রণয়ন ঃ পূর্বে শ্রমিকদের জন্য কোন দেশেই নীতিমালা ছিল না। মালিকরা শ্রমিকদের সাথে ইচ্ছামত ব্যবহার করত। পরবর্তীতে ILO প্রতিষ্ঠার পর শ্রমিকদের সমস্যা সমাধান সময়সীমা নির্ধারণ শ্রমিক ছাঁটাই, নিয়োগ, বেতন, নিরাপত্তা, ছুটি, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি নীতিমালা প্রণয়ন করে। যা শ্রমিকদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।
৩. সামাজিক নিরাপত্তা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ঃ শ্রমিকরা সামাজিক নিরাপত্তায় ভূগত। ILO প্রতিষ্ঠার পর শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান, ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলছে। ফলে শ্রমিকরা বর্তমানে সামাজিক, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সামাজিক ন্যায় বিচার পাচ্ছে ।
৪. জীবনমান উন্নয়ন ঃ শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানউন্নয়নে ILO ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ব্যবস্থা, আবাসন ব্যবস্থা, পুষ্টি, বিনোদন, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ইত্যাদি কর্মসম্পাদনের দ্বারা ILO শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন করে চলছে।
৫. শ্রমজীবীদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা : সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ILO শ্রমবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র এবং ইতালির তুরিনে অবস্থিত উন্নত কারিগরি শিক্ষা রয়েছে। পেশাগত শিক্ষার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে শ্রমজীবীদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। শ্রমিকদের বিভিন্ন বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা নিদের্শনা প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনে ILO বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলছে।
৬. শ্রম সংগঠন প্রতিষ্ঠায় : ILO শ্রম সংস্থা বা ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ের পূর্ণস্বাধীনতা দেয়। ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে ILO শ্রমিকদের জন্য শ্রমিক মালিক দরকষাকষি, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা উপযুক্ত বেতন নির্ধারণ নিশ্চিত করে থাকে।
৭. সহায়তা ও পরামর্শ প্রদান ঃ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে শ্রমিকদের কল্যাণে জাতীয় শ্রমনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, গবেষণা, প্রশিক্ষণ, শিক্ষণ, প্রকাশনা জনসংখ্যা ও পরিবার কল্যাণ, গ্রামোন্নয়ন, জনশক্তি পরিকল্পনা, মানব সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আর্থিক, কারিগরি ও বিশেষ সহায়তা ও
পরামর্শ প্রদান করে ILO বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
৮. আন্তর্জাতিক শ্রমমান নির্ধারণ ঃ শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে ও স্বার্থ সংরক্ষণের মধ্যদিয়ে ILO আন্তর্জাতিক শ্রম মাত্র নির্ধারণ করে থাকে। এর মাধ্যমে শ্রমিকদের সকল সমস্যার সমাধান, শ্রমিক মালিক সম্পর্ক উন্নয়ন, শ্রমিকদের নিরাপত্তা, মজুরি, শ্রমঘণ্টা নির্ধারণ ইত্যাদি তৈরির মাধ্যমে ILO শ্রমিকদের শ্রমমান নির্ধারণ করে বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করে চলছে।
৯. নারী ও শিশু শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে ঃ নারী ও শিশু শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ILO বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলছে। ১৯৯৯ সালে ILO রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায় যে, বিশ্বে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি ২৯ লাখ। শিশু শ্রমিকদের মধ্যে বড় অংশই হচ্ছে নারী শিশুরা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করার মধ্য দিয়ে তাদের
শারিরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার নারী শ্রমিকরা তাদের ন্যয়্য স্ত্ররী, মাতৃকালীন ছুটি, শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়ে থাকে। নারীও শিশুদের এই সকল সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ILO বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। এর মধ্য অন্যতম পদক্ষেপগুলো হচ্ছে শিশু শ্রমআইন প্রণয়ন, শিশুশ্রম রোধ মাতৃকালীন ছুটি, অবিবাহিত
মহিলা ও অবৈধ শিশুদের রক্ষা, মজুরী বৈষম্য হ্রাস ইত্যাদি। এগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ILO নারী ও শিশুদের স্বার্থ সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করে চলছে।
১০. কনভেনশন ব্যবস্থা : শ্রমিকদের সুবিধার্থে ILO প্রতি বছর জুন মাসে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ব্যবস্থা করে থাকে । প্রতিটি সদস্যদেশ এই সম্মেলনের জন্য প্রতিনিধি পাঠানোর সুযোগ পায়। প্রতিনিধিদের মধ্যে সরকারি প্রতিনিধি, মালিক প্রতিনিধি, শ্রমিক প্রতিনিধি উপস্থিত থাকে। সম্মেলন পরিচালনার জন্য ৫৬ সদস্য বিশিষ্ট গভর্নিং বডি থাকে। যার মধ্যে সরকারি প্রতিনিধি ২৮ জন, মালিক প্রতিনিধি ১৪ জন শ্রমিক, প্রতিনিধি ১৪ জন। এই সম্মেলনে শ্রমিক মালিক সুবিধা অসুবিধা ইত্যাদি বিষয়ে অলোচনা করা হয়। যা বাস্তবায়নে ILO বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
১১. শ্রম গবেষণা ইনস্টিটিউট : বিশ্বে জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ শ্রমিক। এই শ্রমিকদের জন্য ILO গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচালনা করে থাকে। এর অন্যতম কার্যক্রম হল শ্রমিকদের কল্যাণে গবেষণা পরিচালনা, তথ্যাদি সংগ্রহ, রিপোর্ট প্রকাশ, ও প্রচারণা করা। এজন্য @ILO International Labour Review, The Bulletin of Labour
Statistics প্রভৃতি সাময়িক প্রকাশ করে থাকে ।ক্রিম বা ক্রিম বারিক্রম পরিক্রম পরি
১২. সমন্বিত কার্যক্রম ঃ ILO শ্রমিকদের স্বার্থে বিভিন্ন সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে। ILO জাতিসংঘ ও এর অন্যান্য সংগঠনের মাধ্যমে এ সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে। ILO এর সহায়তায় যে সকল সংগঠন অবদান রাখে তাদের মধ্যে WHO, UNICEF, UNESCO, ECDSOC অন্যতম। এ সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে ILO তার সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা করে ।
১৩. বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ ঃ ILO শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। এ কর্মসূচির আওতায় রয়েছে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ, শিল্প স্থাপন, নারী উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, জনশক্তি পরিকল্পনা, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা, আধুনিক ও প্রগতিশীল ধারণা প্রবর্তন নার ী-পুরুষের জন্য সম্মানজনক চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি।
১৪. সদস্য দেশগুলোকে সহায়তা প্রদান : ILO এর অন্যতম দায়িত্ব হল এর সদস্য দেশগুলোকে শ্রমিকদের কল্যাণার্থে সহায়তা প্রদান করা। যাতে দেশগুলো জাতীয় শ্রমনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, গবেষণা, প্রশিক্ষণ, শিক্ষণ, প্রকাশনা, জনসংখ্যা ও পরিবার কল্যাণ, গ্রামোন্নয়ন, জনশক্তি পরিকল্পনা, মানবসম্পদ উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়গুলোকে
গুরুত্বের সাথে দেখে সেজন্য ILO সহায়তা প্রদান করে সাহায্যের হাতকে প্রসারিত করে।
১৫. নারী ও পুরুষের সম্মানজনক চাকরির সযোগ বৃদ্ধি : আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা নারী ও পুরুষের সম্মানজনক চাকরির সুযোগ বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে। পূর্বে নারীরা কাজের সুবিধা পেত না তারা গৃহের কাজ ব্যস্ত থাকত। পুরুষেরা অনেক যোগ্যতা থাকার পরও দেখা যেত তেমন ভাল কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারছে না। পরবর্তীতে ILO প্রতিষ্ঠার পর
নারীও পুরুষের সম্মানজনক চাকরি সুযোগ বৃদ্ধি পায় এবং কর্মমূলে বৈষম্য দূরীভূত হয়।
১৬. সরকার, মালিক, শ্রমিক সংলাপকে শালী করতে : ILo শ্রম বিষয়ে শ্রমিক মালিক ও সরকারি সংলাপকে শক্তিশালী করতে প্রতি বছর জুন মাসে সম্মেলনের আয়োজন করে। এ সম্মেলনে ত্রিপক্ষ সংলাপ হয় যা দ্বারা নতুন
নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া গুরুত্ব পায়। এজন্য ILO ত্রিপক্ষ সংলাপ শক্তিশালী করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
১৭. সুপারিশমালা প্রণয়ন ঃ আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা ILO শ্রমিকদের কল্যাণার্থে বেশ কিছু সুপারিশ মালা প্রণয়ন করে থাকে। যার দ্বারা শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক শ্রমমান বৃদ্ধি, শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে লড়াই, পূর্ণকর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থানের উন্নয়ন এবং সম্মানজনক কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা শ্রমিকদের কল্যাণার্থে প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকেই অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। ILO শুধু শ্রমিকদের নিয়েই ক্ষান্ত থাকেন না বরং শ্রমিকদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সরকার শ্রমিক মালিক পক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে সংলাপ করিয়ে অধিকার আদায়ে কাজ করে থাকে। সর্বোপরি শ্রমিকদের ইতিবাচক মনোভাব ঘটাতে ILO তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছে।