উত্তর : ভূমিকা ঃ বাংলাদেশ একটি গ্রামপ্রধান দেশ। অধিকাংশ জনগণই গ্রামে বসবাস করে। শতকরা ৮০ ভাগের বেশি মানুষ গ্রামের ক্ষেত-খামারগুলোতে জীবিকা নির্বাহে প্রযুক্ত। এদের ভাগ্যোন্নয়নে সরকারের সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর গ্রামীণ সমাজসেবা কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে। যার মাধ্যমে ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও
উন্নয়নের ছোঁয়া পৌঁছতে শুরু করেছে। গ্রামীণ সমাজসেবা তার জন্মলগ্ন থেকেই নিরন্তর গ্রামের দুঃখী-অসহায় মানুষদের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। গ্রামগুলোতে এর গুরুত্ব অত্যধিক।
→ গ্রামীণ সমাজসেবা ঃ গ্রামীণ উন্নয়ন সাধনের নিমিত্তে গঠিত সমাজকল্যাণমূলক প্রচেষ্টাই মূলত গ্রামীণ সমাজসেবা হিসেবে গণ্য। এটি একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। যা গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের সার্বিক জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া বয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। সমাজকল্যাণের দৃষ্টিতে বলা যায় যে, সমাজকল্যাণের নীতি ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকারের সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার নামই গ্রামীণ সমাজসেবা কার্যক্রম। হাজার হাজার বেকার যুবক
যুবতী ও বয়স্কদের জন্য এ গ্রামীণ সমাজসেবা আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। Social Services in Bangladesh এর বইয়ে বলা হয় “বাস্তবসম্মত বহুমুখী ও সমন্বিত গ্রাম উন্নয়ন প্রক্রিয়াই হলো গ্রামীণ সমাজসেবা।” গ্রামীণ
সমাজসেবার মাধ্যমে মানবসম্পদের বিকাশের পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি দৃঢ়তর হচ্ছে।
→ গ্রামীণ সমাজসেবার ঐতিহাসিক পটভূমি ঃ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দেশটির অধিকাংশ জনগণ প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে বসবাস করে। দীর্ঘ ২০০ বছর ব্রিটিশ ও তার পরে পাকিস্তানের ২৫ বছরের শাসন-শোষণে গ্রামগুলোর কোনো উন্নয়ন সাধিত হয়নি। তাই দেশ স্বাধীন হবার সাথে সাথে ৮০ ভাগ লোকের বাস গ্রামগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দিকে সরকার দৃষ্টিপাত করতে থাকেন। তৎকালীন সরকারি পরিকল্পনা
পরিষদের নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়নের ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হতে থাকে। নীতি নির্ধারকগণ প্রথমেই বাংলাদেশের গ্রামগুলোর উন্নয়ন সাধনে উৎসাহ দেখায় তাদের ধারণা ছিল জাতীয় উন্নয়ন গ্রামগুলোর উন্নয়নের মধ্যেই নিহিত রয়েছে । ফরশ্রুতিতে, ১৯৭৪ সালে গ্রামীণ সমাজসেবা (Rural Social Services RSS) কর্মসূচি পরীক্ষামূলকভাবে গৃহীত হয়। বাংলাদেশের প্রায় ১৯টি জেলার ১৯টি থানায় পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে গ্রামীণ সমাজসেবা কার্যক্রমের
অগ্রযাত্রা শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিটি থানায় ৮টি শিশুকেন্দ্র, ৪টি যুবকেন্দ্র, ৮টি মাতৃকেন্দ্র, ৪টি বয়স্ক কেন্দ্র ও ১টি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও উৎপাদন কেন্দ্র নির্মিত হয়েছিল। তারপর যখন কর্মসূচিগুলো সফলতা পেল। তা ৪৫টি থানায় সম্প্রসারিত করা হয়। সরকার আবার থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করলে এ কর্মসূচির নাম হয় উপজেলা সমাজসেবা কর্মসূচি। বর্তমানে বাংলাদেশে ৪৭৫টি উপজেলায় এটি উপজেলা সমাজসেবা কর্মসূচি নামে পরিচালিত
হচ্ছে। এর মাধ্যমে সাধারণ জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে। তাই বলা হয়, স্বধীনতাউত্তর এই সমাজসেবা কর্মসূচির গ্রহণ ছিল সোনারবাংলা গড়ার এক ইস্পাতসম প্রচেষ্টা। গ্রামীণ সমাজসেবা প্রকল্পের সফলতার চিত্র ঃ ১৯৭৪ সাল থেকে চালু হওয়া গ্রামীণ সমাজসেবা প্রকল্প অনেক
বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বেশ সফলতার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করছে। নিম্নে এর সফলতার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হলো-
১. অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঃ গ্রামীণ সমাজসেবা প্রকল্পের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গ্রাম-বাংলার কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটতে শুরু করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এর সম্মানিত চেয়ারম্যান ড. আব্দুল্লাহ মিয়া
বলেছেন, শতকরা ৯৫ ভাগ ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে সফল হয়েছে। আর তারা ৩০৮ টাকা পর্যন্ত আয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
২. বেকারত্বের হার হ্রাস ঃ বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গ্রামের হাজার হাজার বেকার যুবক যুবতীদের বিভিন্ন ছোট খাটো কর্মসূচিতে যোগদানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে। ফলে বেকারত্বের হার অনেক কমে গেছে।
৩. মহিলোাাদের ক্ষমতায়ন ঃ বাংলাদেশের শতকরা ৫০% নারী। যারা কোনোরূপ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জড়িত ছিল না। গ্রামীণ সমাজসেবা তাদের প্রশিক্ষণ ও সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে ক্ষমতায়নের ব্যবস্থা করছে।
৪. স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি : বহুসংখ্যক মানুষকে নিরক্ষরতার অন্ধকার থেকে স্বাক্ষরজ্ঞান দান করেছে গ্রামীণ সমাজসেবা তার বিভিন্ন শিশু ও বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রের মাধ্যমে।
৫. স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নতি ঃ গ্রামীণ সমাজসেবার সুগভীর সচেতনতামূলক কর্মসূচি ও বাস্তবমুখী স্বাস্থ্যজ্ঞান দান গ্রামের দুর্বল, নিরক্ষর মানুষকে বিশুদ্ধ পানি পানে ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করেছে। ফলশ্রুতিতে গ্রামের
অধিকাংশ মানুষ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তিলাভ করেছে।
৬. গঠনমূলক চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা ঃ গ্রামীণ সমাজসেবা দেশের গ্রামের মানুষদের জন্য গঠনমূলক চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে।
৭. সামাজিক বনায়নের প্রচেষ্টা : দেশের বৃক্ষরাজির পরিমাণ বৃদ্ধিতে গ্রামীণ সমাজসেবার সুবিধাভোগীদের মাঝে বৃক্ষচারা প্রদান করে রোপণের নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে করে গ্রামের বনভূমির পরিমাণ বেশ কিছুটা বেড়ে গেছে।
উপসংহার ঃ পরিশেষে বলা যায় যে, গ্রামীণ সমাজসেবা হচ্ছে একটি সমন্বিত গ্রাম উন্নয়নের সুদৃঢ় প্রচেষ্টা। ১৯৭১ সালের পর দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে গ্রামগুলোর আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে এ প্রকল্প গৃহীত হয়। নানান চরাই উৎরাই পেরিয়ে আজ এ প্রকল্প কাঙ্ক্ষিত সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছে। হাজার হাজার গ্রামবাসী গ্রামীণ সমাজসেবার বদৌলতে নিজেদের সার্বিক জীবনের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সাধনে সক্ষম হয়েছে