অথবা, গবেষণা নকশা কী? গবেষণা নকশার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, গবেষণা নকশা কাকে বলে? উত্তম গবেষণা নকশার কী কী বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান বিশ্লেষণ কর।
অথবা, গবেষণা নকশার সংজ্ঞা উল্লেখপূর্বক এর বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : গবেষণায় প্রাপ্ত সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে গবেষণার উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের জন্য সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে গবেষণাটি পরিচালনা করার বৈজ্ঞানিক কর্মপরিকল্পনাই হচ্ছে গবেষণা নকশা ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন সমাজ গবেষক গবেষণা নকশার বিভিন্ন রকম সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। এর মধ্যে কতিপয় উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
ক্লেয়ারি সেলটিজ (Claire Selltiz) গবেষণা নকশার সংজ্ঞায় বলেন, পরিমিত প্রক্রিয়ায় গবেষণার উদ্দেশ্যের সাথে সংগতিপূর্ণভাবে উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের লক্ষ্যে বিভিন্ন শর্তের বিন্যাস রাখাই হলো গবেষণা নকশা।
ফ্রেড. এন. কার্লিনজার (Fred. N. Kerlinger) এর মতে, “Research design is the plan, structure and strategy of investigation conceived so as to obtain answers to research questions and to control
variance.” অর্থাৎ, গবেষণা নকশা হচ্ছে গবেষণা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া এবং ভেদ বা অমিল নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা, কাঠামো ও কৌশল বিশ্লেষণ ।
সি. আর. কোথারি (C.R.Kothari) এর ভাষায়, “The research design is the conceptual structure with in which research is conducted; it constitutes the blueprint for the collection, measurement and analysis of data” অর্থাৎ, গবেষণা নকশা হলো প্রত্যয়গত কাঠামো, যার মাধ্যমে গবেষণা পরিচালনা করা হয়; এটি তথ্যসংগ্রহ, পরিমাপ এবং বিশ্লেষণের নীল নকশা হিসেবে গঠন করা হয় ।.
আরল বেবী (Earl Babbie) এর মতে, “Research design addresses the planning of scientific inquiry designing a strategy for finding out something.” অর্থাৎ, গবেষণা নকশা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের পরিকল্পনা নির্দেশ করে নকশা কোনকিছু খুঁজে বের করার কৌশল বিশেষ ।
ব্ল্যালক এবং ব্ল্যালক (Blalock and Blalock) এর ভাষায়, একটি গবেষণা নকশা হলো অনুসন্ধানের আওতায় গৃহীত কোন বিশেষ সমস্যার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ, যার মাধ্যমে কোন গবেষক বা তাত্ত্বিক কোন ঘটনা সম্পর্কিত ব্যাপক অন্তর্দৃষ্টি এবং তথ্যপূর্ণ বর্ধিত জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী হন ।”
পি. ভি. ইয়ং (P. V. Young) এর মতে, “A research design is the logical and systematic planning and directing of a piece of research.” অর্থাৎ, গবেষণা নকশা হলো গবেষণার যৌক্তিক এবং নিয়মতান্ত্রিক পরিকল্পনা ও নির্দেশনা ।সুতরাং বলা যায়, গবেষণার উদ্দেশ্যকে অর্জন করার জন্য সুষ্ঠু ও সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে গবেষণা সম্পাদনের যৌক্তিক কর্ম পরিকল্পনাই হলো গবেষণা নকশা ।
উত্তম গবেষণা নকশা : সামাজিক গবেষণার উদ্দেশ্য অর্জন বা বাস্তবায়নের জন্য গবেষণার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে গবেষক যে যৌক্তিক কর্মপরিকল্পনা (Logical action plan) প্রণয়ন করেন তাকেই গবেষণা নকশা বলে। মূলত গবেষণাকে সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্যই গবেষণা নকশা প্রয়োজন। একটি উত্তম গবেষণা নকশায় গবেষণা সম্পর্কিত কাজের ধাপ বা পর্যায়ের (Stages) একটি সামগ্রিক চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সমাজ গবেষক
সি.আর. কোথারি (C. R. Kothari) বলেন, “Generally, the design which minimises bias and maximises the reliability of the data collected and analysed is considered a good design.” অর্থাৎ, সাধারণভাবে যে নকশায় সর্বনিম্ন মাত্রায় পক্ষপাতিত্ব এবং উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে সর্বোচ্চ মাত্রায় নির্ভরযোগ্যতা বজায় থাকে,
তাকেই উত্তম নকশা বিবেচনা করা হয়।
একটি উত্তম গবেষণা নকশার বৈশিষ্ট্য : একটি উত্তম গবেষণা নকশায় সাধারণত নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান থাকে । যেমন-
১. সঠিক উপাত্ত সংগ্রহের উপযোগী : একটি উত্তম গবেষণা নকশা গবেষণাধীন বিষয় বা সমস্যা সম্পর্কিত সঠিক উপাত্ত সংগ্রহের উপযোগী হতে হবে। কেননা ঠিক উপাত্তের উপরই গবেষণার সাফল্য নির্ভর করে। তাই গবেষণার উদ্দেশ্যকে সফল করে তোলার জন্য উত্তম গবেষণা নকশাকে সঠিক উপাত্ত সংগ্রহের উপযোগী হওয়া আবশ্যক ।
২. নমনীয় : উত্তম গবেষণা নকশা অবশ্যই নমনীয় প্রকৃতির হবে। ফলে গবেষণার জন্য প্রাথমিকভাবে প্রস্তুতকৃত গবেষণা নকশাটি কার্যক্ষেত্রে বা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে গিয়ে গবেষক অনেক সময় তাতে কিছু প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করতে সক্ষম হবেন। –
৩. পূর্বানুমান পরীক্ষার ক্ষমতা : একটি উত্তম গবেষণা নকশা অবশ্যই গবেষণার জন্য গৃহীত পূর্বানুমানকে বস্তুনিষ্ঠভাবে যাচাই বা পরীক্ষার ক্ষমতা থাকতে হবে। কেননা সামাজিক গবেষণার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পূর্বানুমান গ্রহণের মাধ্যমে গবেষণাকার্য পরিচালিত হয়। তাই উত্তম গবেষণা নকশাকে গবেষণার জন্য গৃহীত পূর্বানুমানটিকে বস্তুনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা বা যাচাই করে সেটি গ্রহণ বা বর্জন করার ক্ষমতা থাকতে হবে।
৪. স্থায়ী ভুল সংশোধন : একটি উত্তম গবেষণা নকশা গবেষণার জন্য সংগৃহীত উপাত্তের স্থায়ী ভুল (Constant error) সংশোধনের উপযোগী হবে। কেননা পরীক্ষণমূলক গবেষণার ক্ষেত্রে বাহ্যিক চলককে (External variable) নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে বাহ্যিক চলক অনেক সময়ই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। ফলে গবেষণার জন্য সংগৃহীত উপাত্তের স্থায়ী ভুলের সম্ভাবনা থাকে । কিন্তু গবেষণা নকশা সুষ্ঠুভাবে প্রণীত হলে উপাত্তের এ ধরনের স্থায়ী ভুলের সম্ভাবনা হ্রাস পায় ।
৫. দৈব ভুল হ্রাস : উত্তম গবেষণা নকশায় এমন বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে, যাতে সংগৃহীত উপাত্তের দৈব ভুল (Random error) কম হয় এবং এ ভুলের পরিমাণ নির্ণয় করা যায়। কোন বিষয় বা সমস্যা অনুসন্ধানে দেব ভুলের উদ্ভব হয় প্রধানত গবেষকদের ব্যক্তিগত পার্থক্য এবং নানারকম অজ্ঞাত শর্তের (Unknown condition) প্রভাবে। এ ধরনের ভুল সম্পূর্ণরূপে দূর করা সম্ভব না হলেও গবেষণা নকশা সঠিকভাবে প্রণীত হলে অনেক ক্ষেত্রে এর পরিমাণ হ্রাস করা যায় এবং পরিমাপ করা যায় ।
৬. গবেষণার উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কিত : একটি উত্তম গবেষণা নকশাকে অবশ্যই গবেষণার উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কিত হতে হবে। অন্যথায় গবেষণা নকশার গ্রহণযোগ্যতা (Validity) হ্রাস পায়। ফলে গবেষণার মূল উদ্দেশ্যও ব্যাহত হয় । তাই উত্তম গবেষণা নকশাকে গবেষণার উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কিত হওয়া বাঞ্ছনীয় ।
৭. সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের নির্দেশনা : একটি উত্তম গবেষণা নকশায় গবেষণার জন্য প্রাপ্ত সম্পদের সুষ্ঠু ও সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গবেষণা কাজটি সম্পাদনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। অন্যথায় গবেষণা কাজটিতে অধিক সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় হবে, যা কাম্য নয় । এছাড়াও একটি উত্তম গবেষণা নকশায় গবেষণা কর্মকাণ্ডের সার্বিক কর্মসূচির বিবরণসহ গবেষণার যৌক্তিক
কাঠামোর (Logical structure) উল্লেখ থাকে ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোই মূলত একটি উত্তম গবেষণা নকশায় বিদ্যমান থাকে । আর উত্তম গবেষণা নকশার অনুসরণে গবেষণা কাজটি পরিচালিত হলে সেটি সুষ্ঠু ও নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করা যায় এবং এতে গবেষণার উদ্দেশ্য সহজেই অর্জন করা সম্ভব হয়।