সামাজিক গবেষণা কাকে বলে? সামাজিক গবেষণার ধাপসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, সামাজিক গবেষণা কাকে বলে? সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে কী কী ধাপ গ্রহণ করা হয় আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক গবেষণা কী? সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে কী কী স্তর গ্রহণ করা হয় আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক গবেষণা সংজ্ঞা দাও। সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থাকে যথার্থরূপে ব্যবহার উপযোগী করার জন্য সামাজিক গবেষণা অপরিহার্য। কারণ সামাজিক স্থিতিশীলতা আনয়নে সামাজিক ইস্যুগুলো সম্পর্কে যথার্থরূপে ধারণা থাকা দরকার। এ ইস্যুগুলোর যথার্থরূপে সমাধান একান্ত অপরিহার্য। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি।
সামাজিক গবেষকদের এ কাজে বিশেষ কিছু ধাপ অনুসরণ করতে হয়।
সামাজিক গবেষণা : সামাজিক গবেষণা মূলত বৈজ্ঞানিক গবেষণার একটি। নিয়ে আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষণ করে সঠিক সমাধান খুঁজে বের করে। I একটি নতুন সংস্করণ, যা সামাজিক সমস্যা
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন মনীষী সামাজিক গবেষণা সম্পর্কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হল :
ড. সালাহউদ্দিন এম. আমিনুজ্জামান এর মতে, “A social research entails scientific investigation conducted in the field of social sciences using theories, models, concepts, tools, techniques, processes drawn from the various disciplines of social and behavioral sciences to explain
interpret, understand and improve the social issues, problems and institutions.”
P. V. Young (1975: 30) বলেছেন, “Social research as the systematic method of discovering new facts or verifying old facts, their sequences, inter relationships, causal explanation and the natural laws which govern them.”
সামাজিক গবেষণা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, “Social research is a method of studying analyzing and conceptualizing social life in order to extend, modify, corrects or verify knowledge wheather that knowledge aids in construction of a theory or in practice of an art.” SC)
P. V. Young সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে মূল চারটি উদ্দেশ্যকে চিহ্নিত করেছেন। যথা :
কোন সামাজিক সমস্যাকে অনুধাবন করা, বিশ্লেষণ করা ও ব্যাখ্যা করা। সমাজ গবেষণা মানুষকে অজানা সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে সাহায্য করে
সামাজিক সমস্যার নীতিনির্ধারণে গবেষণার সাহায্য দরকার।
bi নতুন তত্ত্ব, প্রত্যয় এবং কৌশল নির্ধারণের জন্য সমাজ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
সামাজিক গবেষণার ধাপসমূহ (Steps of social research) : সামাজিক গবেষণা হল একটি সুনির্দিষ্ট ইস্যু বা সমস্যাকে নিয়ে বিশ্লেষণপূর্বক একটা সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। এ কাজের জন্য যে ধাপ অনুসরণ করা
হয় নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হল :
১. সমস্যা চিহ্নিতকরণ : গবেষণা কাজে একজন গবেষকের প্রধান ও প্রথম কাজ হল প্রচলিত সমস্যাবলি হতে গ্রহণযোগ্য এবং উপযুক্ত সমস্যাকে চিহ্নিত করা। কারণ সমাজে অনেক সমস্যা আছে। এ সমস্যাগুলো থেকে গবেষণাযোগ্য সমস্যাকে বাছাই করা হয়। তবে এ বাছাইয়ের সময় বিশেষ কিছু দিকের প্রতি নজর রাখতে হয়। যেমন-
যেসব সমস্যা জটিল ও সমাধানযোগ্য,
যেসব সমস্যা সহজে সমাধানযোগ্য এবং
সমস্যাটি বিজ্ঞানভিত্তিক বিচার বিশ্লেষণযোগ্য হতে হবে।
২. সমস্যা নির্বাচন : সমস্যা সঠিকভাবে চিহ্নিতকরণের পর যে বিষয়টি চলে আসে তা হল সমস্যার মধ্য থেকে গবেষণাযোগ্য সমস্যাকে বাছাই করা। গবেষণার জন্য সর্বোত্তম ইস্যু, সর্বোত্তম বিষয়কে উপযুক্ত মনে করে বাছাই করা অপরিহার্য। বাছাইয়ের জন্য নিম্নোক্ত বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা দরকার :
ক. সমস্যাটির প্রভাব ও বিস্তৃতি,
গবেষণার কাজের বাস্তবতা ও উপযোগিতা,
সমস্যাটি অবশ্যই সমাধানযোগ্য হতে হবে,
ঘ. গবেষণার বিষয়টি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে সহজলভ্যতা।
৩. সমস্যা সম্পর্কে প্রচলিত জ্ঞান ও মতবাদের সাথে পরিচিত হওয়া : সমস্যা নির্বাচনের পর এ পর্যায়ে সমস্যার উপর প্রকাশিত মন্তব্য, পূর্বোক্ত গবেষণা এবং মতবাদ প্রভৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধ, বই, আর্টিকেল প্রভৃতি বিশ্লেষণ করে দেখা হয়। যার মাধ্যমে গবেষক অতি সহজেই জ্ঞান লাভ এবং সমস্যা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারেন। এখানে
নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয় :
সমস্যা প্রকাশে সহায়তা প্রদান করে সমস্যার গুরুত্বকে বেশি জোর দেয়, গবেষণা কাজের প্রাথমিক খসড়া প্রস্তুতকরণে সহায়তা করে, সমস্যার সীমা নির্ধারণ সহজ হয়।
৪.সমস্যার কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান : এ পর্যায়ে সমস্যাকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যাতে সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ থেকে প্রদত্ত সমস্যাকে পৃথক করা সহজ হয়। এখানে গবেষণা কাজের সামগ্রিক পটভূমি তুলে ধরা হয়, যার উপর ভিত্তি করে গবেষণার লক্ষ্য নির্ধারণ করা যায়। সাথে সাথে গবেষণা কাজে ব্যবহৃত সমস্যার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও অর্থবোধক ধারণা দেওয়া হয়, যাতে গবেষক অতি সহজেই এর ধারণা উপলব্ধি করতে পারে।
৫. কার্যকরী অনুমান গঠন : এ পর্যায়ে গবেষণা কার্যের স্থলে কার্যক্রম শুরু হয় যা অনুমাননির্ভর। আর অনুমান (Hypothesis) হল যে কোন যুক্তিসঙ্গত ধারণা, যা প্রত্যক্ষণ বা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট যুক্তি থাকে। আর কার্যকরী অনুমান গবেষণার ক্ষেত্রে সঠিক নির্দেশনা প্রদান করে থাকে। আর অনুমান করার জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হয়।
৬. নকশা প্রস্তুত করা : নকশাকে গবেষকের গবেষণামূলক কার্যাবলির পথনির্দেশক বলা হয়। একজন স্থাপত্য শিল্পীর কাছে নকশা (Design) এর উপর ভিত্তি করে গবেষক তাঁর গবেষণা কার্য পরিচালনা করে থাকে। এ নকশাতে গবেষণা কাজের বিষয়বস্তু, যৌক্তিকতা, তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি, তথ্য বিশ্লেষণ, প্রক্রিয়া, সময় নির্ধারণ, আর্থিক বরাদ্দ, প্রশাসনিক কাঠামো প্রভৃতি উল্লেখ করা হয়।
৭. তথ্য সংগ্রহের হাতিয়ার নির্ধারণ : এ পর্যায়ে দেখানো হয় যে, গবেষণা কার্যের জন্য প্রদত্ত তথ্য কি উপায়ে এবং কোন পদ্ধতির সাহায্যে নির্ণয় করা হয়। তবে তথ্য নির্ভরযোগ্য কি না তা এ যন্ত্রের উপর নির্ভর করে। তথ্য সংগ্রহের
উপায়ের উপর নির্ভর করে তথ্যটি কতটুকু নির্ভরযোগ্য (Reliable), কতটুকু নির্ভুল (Precise) ও যুক্তিপূর্ণ (Valid)।
৮. তথ্য সংগ্ৰহ : তথ্য সংগ্রহ সামাজিক গবেষণার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বা স্তর, যার উপর গবেষণার যথার্থতা ও সঠিকতা নির্ভর করে। এখানে গবেষক গবেষণার কার্যে ব্যবহৃত তথ্য সংগ্রহকারী, তত্ত্বাবধানকারী, তথ্য সংগ্রহের সময়সীমা, ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি নির্ধারণ করেন। তবে এখানে গবেষককে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।
৯. তথ্য বিশ্লেষণ : এ পর্যায়ে সংগৃহীত তথ্যসমূহকে প্রক্রিয়াজাত ও বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষকের অনুমানকৃত সিদ্ধান্তের সাথে সংগৃহীত তথ্যের কতটুকু মিল রয়েছে এটা বিচার বিশ্লেষণ করে দেখেন। তবে তথ্যের যৌক্তিকতা কতটুকু এটা বিশ্লেষণ করেন গবেষক।
১০. তথ্যের মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যা : গবেষণা কাজে ব্যবহৃত তথ্যসমূহকে মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যা করা হয় এ পর্যায়ে। সংগৃহীত তথ্যের ব্যাখ্যার মাধ্যমে তথ্যের প্রকৃতি, পরিধি প্রভৃতি মূল্যায়ন করা হয়। এখানে আরও লক্ষ্য করা হয় যে,
সংগৃহীত তথ্যসমূহ গবেষণা কাজে কতটুকু সন্তোষজনক।
১১. গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ : গবেষণা কাজের সর্বশেষ স্তর হচ্ছে প্রাপ্ত ফলাফল। সংক্ষিপ্ত ও সহজবোধ্য করে প্রকাশ করা হয় সামাজিক গবেষণার চূড়ান্ত ফলাফল বা রিপোর্ট। তবে রেখাচিত্র, মানচিত্র, গ্রাফ, প্রামাণ্য চিত্র প্রভৃতির মাধ্যমে এ রিপোর্ট পেশ করা হয়। তবে রিপোর্টে সাধারণত নিম্নোক্ত বিষয়গুলো প্রকাশ করা হয় :
সমস্যার সংজ্ঞা,
গবেষণার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ,
গবেষণা কার্যের পদ্ধতি,
গবেষণার ফলাফল এবং
ফলাফলের ব্যবহারিক দিক প্রভৃতি।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, সামাজিক গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সামাজিক গবেষণার জন্য বিশেষ কিছু স্তর অনুসরণ করা হয়। এ স্তরগুলোর গুরুত্ব সমান। এ পদক্ষেপগুলো যদি সঠিকভাবে
অনুসরণ করা হয় তবে তা সাফল্যজনকভাবে শেষ হবে।