সামাজিক কার্যক্রম ও সামাজিক আইনের মধ্যে সম্পর্ক লিখ।

অথবা, সামাজিক কার্যক্রম ও সামাজিক আইনের মধ্যে সাদৃশ্য লিখ।
অথবা, সামাজিক কার্যক্রম ও সামাজিক আইনের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক লিখ।
অথবা, সামাজিক কার্যক্রম ও সামাজিক আইনের মধ্যে সামঞ্জস্য।
উত্তরায় ভূমিকা : সমাজকর্মের একটি সাহায্যকারী পদ্ধতি হচ্ছে সামাজিক কার্যক্রম। এটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার সুসংগঠিত দলীয় প্রচেষ্টা। সামাজিক কার্যক্রম জনগণের মাঝে সচেতনতা আনয়ন করে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাঞ্ছিত পরিবর্তন ও সংস্কার সাধনের জন্য সামাজিক নীতি, আইন ও প্রশাসনকে প্রভাবিত করে থাকে। সমাজকর্ম
পেশার জ্ঞান, মূল্যবোধ ও আদর্শের আওতায় পরিচালিত সমন্বিত ও সুশৃঙ্খল কার্যক্রম থেকে সামাজিক কার্যক্রম প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সমাজের বিদ্যমান যেসব রীতিনীতি, কুসংস্কার, প্রথা সমাজকল্যাণের লক্ষ্য অর্জনে বাধার সৃষ্টি করে সেসবের দূরীকরণ, পরিবর্তন, সংশোধন বা নতুন আইন প্রবর্তনের জন্য সমাজকর্মী পরিকল্পিত ও সংগঠিত উপায়ে যে যাপক গণসচেতনা সৃষ্টি ও দলীয় প্রচেষ্টা গড়ে তোলেন তাকে সামাজিক কার্যক্রম বলে।
সামাজিক কার্যক্রম ও সামাজিক আইনের সম্পর্ক : সামাজিক কার্যক্রম ও সামাজিক আইনের মধ্যে
ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিম্নে বর্ণনা করা হলো :
১. পরস্পর সহায়ক ও পরিপূরক : সামাজিক কার্যক্রম ও সামাজিক আইন একে অপরের পরিপূরক ও সহায়ক। সামাজিক আইন সামাজিক কার্যক্রমকে শক্তি যুগিয়ে থাকে। অপরদিকে সামাজিক কার্যক্রম সামাজিক আইনের সংশোধন ও বাস্তবায়নে সহায়তা করে।
২. একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : সামাজিক কার্যক্রম ও সামাজিক আইন অভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে কাজ করে। এ প্রসঙ্গে ডব্লিউ. এ. ফ্রিডল্যান্ডার বলেছেন, “সামাজিক কার্যক্রমের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সামাজিক আইন, স্বাস্থ্য ও
সমাজসেবার উন্নয়ন।” সমাজ থেকে কুপ্রথা দূরীকরণ, অবহেলিত শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা, সামাজিক নীতি প্রণয়ন, সমাজের কল্যাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৩. পরিকল্পিত পরিবর্তন আনয়ন : সামাজিক কার্যক্রম ও সামাজিক আইন উভয়েই সমাজের পরিকল্পিত ও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনয়নে প্রচেষ্টা চালায়। এজন্য উভয়েই সামাজিক অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টিকারী উপাদানসমূহকে প্রতিরোধের মাধ্যমে সামাজিক প্রগতি আনয়ন করে থাকে। এ জাতীয় পরিবর্তনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। এর ফলে সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয় এবং সামাজিক সমস্যার সমাধান সহজতর হয়।
৪. পদ্ধতিগত সাদৃশ্য : পদ্ধতি বা কৌশলগত দিক থেকে সামাজিক কার্যক্রম ও সামাজিক আইনের মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান। সামাজিক কার্যক্রম সমাজের কল্যাণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। এজন্য এর রয়েছে বিভিন্ন পদ্ধতি, কৌশল ও মডেল। এক্ষেত্রে সামাজিক কার্যক্রম প্ররোচনামূলক সহযোগিতা, প্রতিযোগিতা, প্রভৃতি এবং আইনানুগ সামাজিক কার্যক্রম মডেল অনুশীলন করে থাকে। এর ফলে উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে।
৫. সমাজকল্যাণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন : সামাজিক কার্যক্রম ও সামাজিক আইন উভয়েই জনগণের স্বার্থ তথা জনকল্যাণে কাজ করে থাকে। সামাজিক কার্যক্রম শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন, অপরাধ সংশোধন প্রভৃতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। অন্যদিকে সামাজিক আইন ও সমাজকল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে সমবায়, সামাজিক নিরাপত্তা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি কাজ পরিচালিত করে।
৬. সমাজ কাঠামো ও উপযুক্ত পরিবেশ : সামাজিক কার্যক্রম প্রচলিত সমাজ কাঠামো ও আইনের আওতায় পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে সামাজিক আইন সামাজিক কার্যক্রম বাস্তবায়নে উৎসাহ যোগায়। অন্যদিকে উপযুক্ত পরিবেশের মাধ্যমে সামাজিক আইন বাস্তবায়িত হয়। উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে সামাজিক কার্যক্রম সামাজিক আইনকে সাহায্য করে।
৭. সমাজকর্ম পদ্ধতির সফলতা : স মাজকর্ম পদ্ধতির প্রয়োগ ও এর সফলতা অর্জনে সামাজিক কার্যক্রম ও সামাজিক আইন যুগপৎভাবে সহায়তা করে। সামাজিক উন্নয়নকে ফলপ্রসূ করার জন্য সামাজিক কার্যক্রমের কলাকৌশল প্রয়োগে সামাজিক আইন সহায়তা করে থাকে। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর আলী আশরাফ বলেন, “Social action through laffers to social work is a valuable method achieving healthy social change and development”.
৮. জনমত গঠন : নতুন আইন প্রণয়ন বা পুরাতন আইন সংশোধনের জন্য ইতিবাচক সামাজিক পরিবেশ অত্যাবশ্যক। অনুকূল পরিবেশের জন্য চাই প্রবল জনমত। সুশৃঙ্খল ও কার্যকর জনমত সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমেই গড়ে উঠে। ফলে সামাজিক আইনের পরিপূর্ণতার জন্য সামাজিক কার্যক্রম অপরিহার্য, অন্যদিকে, সামাজিক আইন
সামাজিক কার্যক্রমকে কার্যকর ও অর্থবহ করে তোলে।
৯. মানুষের মঙ্গল বিধান : মানুষের সার্বিক মঙ্গল বিধানে উভয়ই কাজ করে থাকে। এক্ষেত্রে সামাজিক কার্যক্রম ও সামাজিক আইন উভয়ে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকে। এছাড়া একই লক্ষ্যে উভয়ে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ নারীনির্যাতন কার্যক্রম এবং নারীনির্যাতন দমন আইন।
১০. সামাজিক নীতি ও আইনের বাস্তবায়ন : সামাজিক নীতি ও আইন বাস্তবায়নে উভয়ে কাজ করে থাকে। সামাজিক নীতি ও আইন প্রণয়নে বিশেষভাবে সহায়তা করে সামাজিক কার্যক্রম। আবার সামাজিক কার্যক্রমকে পরিপূর্ণতা দিয়ে থাকে সামাজিক আইন।
১১. সামাজিক নিরাপত্তা বিধান : সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা করে সামাজিক কার্যক্রম ও সামাজিক আইন। সামাজিক আইন একদিকে যেমন সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। তেমনি অন্যদিকে সামাজিক আইন সামাজিক দুর্যোগ মোকাবিলার মাধ্যমে অনিশ্চয়তা দূর করার ব্যবস্থা করে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২৩ সালের শ্রমিক ক্ষতিপূরণ আইন।
১২. কর্তৃপক্ষের প্রতি চাপ প্রয়োগ : সামাজিক কার্যক্রম যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতি চাপ প্রয়োগ করে। কর্তৃপক্ষ তথ্য সংগ্রহ ও জনগণের মতামত সাপেক্ষে আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে সামাজিক কার্যক্রমের লক্ষ্য সামাজিক আইনের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়।
১৩. অত্যাচার অবিচার প্রতিরোধ : সমাজে বিদ্যমান অত্যাচার অবিচার বা শোষণ নির্যাতন প্রতিরোধের মাধ্যমে সুন্দর সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সামাজিক কার্যক্রম ও সামাজিক আইন উভয়েরই লক্ষ্য। উভয়ই একদিকে অবহেলিত ও শোষিত মানুষের অধিকার আদায় করে, অন্যদিকে আইনের মাধ্যমে এসব প্রতিকূল ঘটনার অবসান ঘটায়। উদাহরণস্বরূপ কৃষক ঋণমুক্তি আন্দোলন।
১৪. অন্যান্য : সামাজিক কার্যক্রম ও সামাজিক আইন আরো যেসব বিষয়ে এক সাথে কাজ করে সেগুলো হলো নারী, শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, কৃষক, শ্রমিক প্রভৃতি শ্রেণির উন্নয়ন সাধন করা। এসব বিশেষ শ্রেণির অধিকার আদাে উভয়েই তৎপর।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, সামাজিক কার্যক্রম ও সামাজিক আইনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে উভয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে সমাজ সংস্কার তথা সমাজের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে।