বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টির প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টির কী কী বৈশিষ্ট্য তুমি লক্ষ্য কর তা আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টির মানদণ্ড ও প্রকৃতির ধরন আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টির বিষয়বস্তু ও ধরন আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি দরিদ্র দেশ। সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা এ দেশ বারবার বিদেশীদের হাতে শোষিত ও নির্যাতিত হয়েছে। বাংলাদেশ মূলত কৃষিভিত্তিক দেশ। ব্রিটিশরা এদেশকে প্রায় দু’শ বছর শাসন করেছিল। মূলত ব্রিটিশরা এদেশকে তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত করেছিল। ফলে এদেশে শিল্পকারখানার তেমন বিকাশ সাধন হয় নি। অন্যদিকে, এদেশের কৃষিকে ধ্বংস করার জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে জমিকে জমিদারদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। যার কারণে সাধারণ কৃষকরা পরিশ্রম করেও তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন করতে পারে নি। ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, যোগাযোগ ক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারে নি। সেজন্য বাংলাদেশে এখনও গ্রামীণ সমষ্টি বেশি পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে, শহরে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও গ্রামীণ জনসমষ্টিতে এখনও লাগে নি। ফলে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টি এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের দাবিদার।
বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টির বৈশিষ্ট্য : বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টি সহজ সরল ও উদার। তারা যুগ যুগ ধরে মিলেমিশে বসবাস করে। নানা সমস্যায় জর্জরিত হলেও তাদের চাহিদা কম। ফলে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টিতে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে আলোচনা করা হল :
১. কৃষিভিত্তিক পেশা : বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশে মানুষের প্রধান জীবিকা হল কৃষি। গ্রামীণ জনসমষ্টিতে কৃষিকাজ বেশি পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট মতে বাংলাদেশের শতকরা ৬৩ জন কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে এবং জিডিপিতে ৩৫ শতাংশ অবদান রাখে কৃষিখাত। এছাড়াও অন্যান্য পেশার লোক বাস করে। তবে সেসব পেশাও কৃষিকাজকে সহায়তা করে থাকে। বাংলাদেশের কৃষকরা তাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বেশিরভাগই
নিজেরা উৎপাদন করে। কৃষকদের উৎপাদিত ফসল সারাদেশের লোক ভোগ করে। গ্রামীণ জনসমষ্টির পুরুষ ও মহিলা উভয়ই কৃষিকাজের সাথে জড়িত।
২. জনসংখ্যার ঘনত্ব কম : বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টির অন্যতম বেশিষ্ট্য হল জনসংখ্যার ঘনত্ব কম। শহরের তুলনায় গ্রামের জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক কম। শুধু তাই নয়, গ্রামের বাড়িগুলোর মাঝে যথেষ্ট ফাঁক থাকে। তাছাড়া গ্রামের বাড়িঘরও বেশ পরিচ্ছন্ন। গাছপালা অনেক বেশি। ফলে এখানে মুক্ত বায়ু সেবন করা যায়। শহরের মত ইট পাথরের বাড়িঘর খুব কম। তবে ইদানিং গ্রামেও এ ধরনের বাড়িঘর হচ্ছে।
৩. জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি : গ্রামীণ জনসমষ্টির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। গ্রামের অজ্ঞ ও অশিক্ষিত মানুষ জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল সম্পর্কে অবগত নয়। তাছাড়া কৃষিকাজে সহায়তা ও বৃদ্ধ বয়সে নিরাপত্তার জন্য তারা অধিক সন্তান জন্ম দিয়ে থাকে। ফলে শহরের তুলনায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে জন্মহারের প্রবণতা বেশি।
৪. শিক্ষার হার কম : গ্রামীণ জনসমষ্টির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল শিক্ষার হার অনেক কম। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকার মানুষ অজ্ঞ, নিরক্ষর ও অশিক্ষিত। তারা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারে না। গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কম। যার কারণে গ্রামের মানুষের মধ্যে শিক্ষার হার কম। ফলে তাদের মধ্যে গোঁড়ামি ও কুসংস্কার বেশি। তবে ইদানিং গ্রামের মানুষের মধ্যেও শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৫. আরোপিত সামাজিক মর্যাদা : বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল আরোপিত সামাজিক মর্যাদা। সামাজিক মর্যাদা দু’রকম। যথা : ১. অর্জিত সামাজিক মর্যাদা ও ২. আরোপিত সামাজিক মর্য াদা। অর্জিত পূর্ণদা ব্যক্তিকে অর্জন করে নিতে হয়। কিন্তু আরোপিত সামাজিক মর্যাদা বংশানুক্রমে ব্যক্তি পায়। বাংলাদেশে গ্রামীণ জনসমষ্টিতে
বংশমর্যাদা অনুসারে সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ উচ্চবংশীয় ঘরের ছেলে মূর্খ হলেও সে সম্মান পায়।
৬. পরিবারের আয়তন : বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পরিবারের আয়তন বড়। গ্রামে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। তাছাড়া সবাই এক বাড়িতে বসবাস করে বলে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি থাকে। বড় পরিবার বলে অনেক সুখও থাকে আবার দুঃখও থাকে। তবে গ্রামের মানুষ এখন সচেতন হয়ে উঠছে। তারাও ছোট পরিবার গঠন করছে।
৭. যৌথ পরিবার ব্যবস্থা : বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল যৌথ পরিবার ব্যবস্থা বিদ্যমান। অর্থাৎ গ্রামীণ এলাকায় মা-বাবা, ভাইবোন, দাদা-দাদী, চাচা-চাচী ও আত্মীয়স্বজন এক সাথে বসবাস করে। অন্যদিকে, শহর এলাকায় স্বামী-স্ত্রী এক সাথে বসবাস করে। তবে গ্রামেও ইদানিং একক পরিবার গঠনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
৮. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর : বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা খুবই কার্যকর । গ্রামীণ জনসমষ্টির যেসব সামাজিক নিয়মকানুন, আচার-অনুষ্ঠান ও মূল্যবোধ রয়েছে তা কঠোরভাবে মেনে চলা হয় । কেউ এসব নিয়মনীতি ভঙ্গ করলে তার কঠিন শাস্তি হয়। গ্রামের মুরুব্বিরা এ শাস্তির ব্যবস্থা করেন।
. ৯. সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় : বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সামাজিক বন্ধন অত্যন্ত সুদৃঢ়। দীর্ঘদিন একসাথে বসবাস করার ফলে তাদের মধ্যে এ বন্ধন গড়ে উঠেছে। সেজন্য সমাজের কেউ বিপদে পড়লে অন্যরা এসে সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে দাওয়াত করে। একে অন্যের সাথে ভাব বিনিময় করে। ফলে তাদের মধ্যে আন্তরিকতা অনেক বেশি।
১০. সামাজিক গতিশীলতার অভাব : বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টির মধ্যে সামাজিক গতিশীলতার অভাব। অর্থাৎ
তারা পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়, নতুন কিছু গ্রহণ করতে চায় না। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক নিয়মকানুন, আচার-অনুষ্ঠান ও মূল্যবোধ তারা ত্যাগ করতে চায় না। যদিও তা তাদের জন্য অকল্যাণকর হয়। সেজন্য তাদের মধ্যে গতিশীলতা কম। তারা এক জায়গায় পড়ে থাকে। ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য অন্য জায়গায় গমন করে না।
১১. অপরিবর্তনীয় পেশা : বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তারা পেশা পরিবর্তন করতে পারে না। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষা, যোগ্যতা ও দক্ষতা কম। ফলে তারা যে যে পেশায় নিয়োজিত সে সেই পেশায় থাকে। অন্য পেশায় যায় না। যেমন-একজন কৃষক সে সারাজীবন কৃষকই থাকতে চায়। সে তার পেশার পরিবর্তন করে ব্যবসায়ী বা রিকশাচালক হতে চায় না।
১২. দলাদলি ও সংঘর্ষ : বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টিতে দলাদলি ও সংঘর্ষও ঘটে। যদিও গ্রামের মানুষ মিলেমিশে এক সাথে বসবাস করে। তারপরও জমিজমা ও অন্যান্য কারণে সংঘর্ষ, মারামারি, এমনকি মামলা মোকদ্দমা হয়ে থাকে। অনেক সময় গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে অনেকে প্রাণ হারায় ও অনেক ক্ষয়ক্ষতি সাধন হয়। গ্রাম্য রাজনীতির কারণে এ প্রবণতা
বর্তমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৩. কর্জ ব্যবস্থা : বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টিতে কর্জ ব্যবস্থা এখনও প্রচলিত আছে। বাংলাদেশে গ্রামীণ জনগণ পাশের বাড়ি বা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকাপয়সা, চাল, ডাল, তরিতরকারি ধার নেয়। সময়মতো তা শোধ করে। এ কর্জ ব্যবস্থা তাদের মধ্যে সম্প্রীতির বহিঃপ্রকাশ। তবে মহাজনরা কর্জ দিয়ে অনেককে সর্বশান্ত করে থাকে। ইদানিং গ্রাম এলাকায় NGO ও ব্যাংক ব্যবস্থা চালু হয়েছে। ফলে তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে।
১৪. সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম : বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অন্যতম বৈ শিষ্ট্য হল সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় ক্লাব, কমিউনিটি সেন্টার ইত্যাদির সংখ্যা কম। তাছাড়া গ্রাম এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কম। ফলে গ্রামীণ জনগণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে অনগ্রসর।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা হতে একথা বলা যায় যে, বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণ অত্যন্ত সহজ ও সরল জীবনযাপন করে। তারা যুগ যুগ ধরে এক সাথে বসবাসের ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের সামাজিক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয়েছে যা অন্য কোন দেশে দেখা যায় না। সেজন্য বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টির বৈশিষ্ট্য আমাদের গর্বের বিষয়।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a6%b8%e0%a6%ae%e0%a6%b7%e0%a7%8d%e0%a6%9f%e0%a6%bf/