অথবা, জনসমষ্টি বলতে কী বুঝ? গ্রামীণ ও শহর জনসমষ্টির মধ্যে বিদ্যমান বৈসাদৃশ্যসমূহ তুলে ধর।
অথবা, জনসমষ্টি কাকে বলে? গ্রামীণ ও শহর জনসমষ্টির মধ্যে বিদ্যমান অসামঞ্জস্য তুলে ধর।
অথবা, জনসমষ্টি কী? গ্রামীণ ও শহর জনসমষ্টির মধ্যে বিদ্যমান বৈসাদৃশ্যসমূহ তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ‘Survival is the fittest’ এ নীতির বিপরীত দর্শন থেকেই সমষ্টি বা সমষ্টি সংগঠন প্রত্যয়টির উদ্ভব। সামাজিক জীব হিসেবে সমাজে সকল মানুষের যেমন বেঁচে থাকা ও সুযোগ সুবিধা ভোগ করার অধিকার আছে তেমনি দুর্বলেরও সমাজে বেঁচে থাকা ও সুযোগ সুবিধা ভোগ করার অধিকার আছে। সমাজের সকল লোক ও সকল দলের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সমাজকে আরও সুন্দর করে গড়ে তোলা যায়। মূলত এ দর্শন থেকেই সমষ্টি বা সম্প্রদায় প্রত্যয়ের উদ্ভব।
জনসমষ্টি : সাধারণ অর্থে জনসমষ্টি বলতে বুঝায় একটি ভৌগোলিক অঞ্চল, যেখানে কিছুসংখ্যক লোক জীবনধারণের সাধারণ উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে সমবেতভাবে জীবনযাপন করে এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রথা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নিজেদের বহুমুখী চাহিদা পূরণ করে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জনসমষ্টিকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। নিম্নে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী প্রদত্ত জনসমষ্টির কয়েকটি সংজ্ঞা প্রদান করা হল ঃ সমাজবিজ্ঞানী লুন্ডবার্গ (Lundberg) তাঁর ‘Sociology’ গ্রন্থে বলেছেন, “Community is a human population iving within a limited geography area and carrying on a common inter dependent life.” অর্থাৎ,
জনসমষ্টি হল এমন একদল লোক যারা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় পরস্পর নির্ভরশীল সাধারণ জীবনযাপন করে আসছে।
জনসমষ্টিকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানী Arthur Dunham তাঁর ‘Community Welfare Organization’ গ্রন্থে বলেছেন, “A Community is a group of human beings, settled in a fairly compact and contingences geographical area and having significant elements of common life, as shown by manners, customs, traditions and modes of speech.”
সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার (MacIver) তাঁর ‘Society its Structure and Changes’ গ্রন্থে বলেছেন, “জনসমষ্টি বলতে এমন একটি জনসমষ্টিকে বুঝায় যাদের বাসস্থান, স্বার্থ ও জীবনধারা এক ও অভিন্ন।” জনসমষ্টির উল্লেখযোগ্য একটি সংজ্ঞা প্রদান করেছেন সমাজবিজ্ঞানী আর. এল. ওয়ারেন (R. L. Warren)। তিনি তাঁর The Community in America’ গ্রন্থে জনসমষ্টি বলতে বুঝিয়েছেন, “That combination of social units
and systems that perform. The major social functions relevant to meetings peoples needs on a local level.” অর্থাৎ, জনসমষ্টি হল দৈনন্দিন জীবনে মানুষ নিজেদের প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে যেসব কার্যাবলি সম্পন্ন করে সেগুলোর সংগঠন।
সমাজবিজ্ঞানী কিংসলে এবং ডেভিস (Kingsley & Devis) তাঁর ‘Human Society’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, “জনসমষ্টি বলতে একটি নির্দিষ্ট এলাকার জনগোষ্ঠীকে বুঝায়, যারা একই সামাজিক রীতিনীতিতে আবদ্ধ।”
উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে বলা যায় যে, জনসমষ্টি হল একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাসরত একদল লোকের সমাবেশ, যাদের পারস্পরিক স্বার্থ অভিন্ন ও সাদৃশ্যপূর্ণ এবং যাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান
এবং তারা এমন কতকগুলো প্রতিষ্ঠানের অধিকারী যেগুলো তাদের মৌলিক প্রয়োজন মিটাতে সাহায্য করে এবং যেসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তারা যৌথভাবে অংশগ্রহণ করে। উদাহরণস্বরূপ গ্রাম সম্প্রদায় বা সমষ্টি, শহর সমষ্টি ইত্যাদি । গ্রামীণ এবং শহর জনসমষ্টির মাঝে বিদ্যমান পার্থক্য (Differences between Urban and Rural Community) : গ্রামীণ এবং শহর জনসমষ্টির অবস্থা, সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি সুচারুভাবে পর্যালোচনা করলেই গ্রামীণ এবং শহর জনসমষ্টির মাঝে বিদ্যমান পার্থক্য, বৈসাদৃশ্য সুস্পষ্টভাবে আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে। নিম্নে
গ্রামীণ এবং শহর জনসমষ্টির মাঝে বিদ্যমান প্রধান প্রধান পার্থক্য ও বৈসাদৃশ্যসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করা হল ঃ
১. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে : গ্রামীণ জনসমষ্টির অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক। খুব কমসংখ্যক লোকই অন্যান্য পেশার সাথে জড়িত। অপরদিকে, শহরের জনসমষ্টির পেশা বিভিন্নমুখী। তাছাড়া গ্রামীণ লোকদের আ
য় শহরের লোকদের আয়ের তুলনায় অনেক কম।
২. মানবিক দৃষ্টিতে : শহরের জনসমষ্টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণত কুসংস্কারমুক্ত, উদার দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী । শিক্ষা প্রসারের ফলে শহরের লোকজন সংস্কৃতি চেতনা সম্পন্ন হয়। অপরদিকে, গ্রামীণ জনসমষ্টি ধর্মীয় গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সংকীর্ণ মনের অধিকারী।
৩. গতিশীলতা : গ্রামীণ জনসমষ্টি সাধারণত স্থবির এবং স্থিতিশীল। অপরদিকে, শহরের জনসমষ্টি সদা পরিবর্তনশীল। তারা যে কোন পরিবর্তন সহজে মেনে নেয় এবং যে কোন পরিবর্তিত অবস্থার সাথে সহজেই নিজেদেরকে খাপখাইয়ে নিতে পারে।
৪. স্তরবিন্যাস : গ্রামীণ জনসমষ্টিতে সাধারণত অর্জিত পদমর্যাদার পরিবর্তে আরোপিত পদমর্যাদা বেশি দেখা যায় এবং একেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। অপরদিকে, শহরে স্ব-স্ব যোগ্যতার ভিত্তিতে এবং আর্থিক অবস্থার উপর পদমর্যাদা নির্ভর করে।
৫. দৃষ্টিভঙ্গিতে : গ্রামীণ জনসমষ্টি আন্তরিকতাপূর্ণ হৃদয়ের অধিকারী। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সাহায্য সহযোগিতার ছাপ
সুস্পষ্ট। অপরদিকে, শহরের জনসমষ্টি কৃত্রিমতায় বিশ্বাসী। তারা সবসময় নিজ স্বার্থকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়।
৬. ধর্মীয় মূল্যবোধ : গ্রামীণ জনগণ সাধারণত ধর্মভীরু হয়। ধর্মীয় নিয়মনীতির আওতায় তাদের জীবন অতিবাহিত হয়। অপরদিকে, শহরের জনসমষ্টি হয় বাস্তববাদী। ধর্মীয় মূল্যবোধ তাদের জীবনে তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
৭. নেতৃত্ব : গ্রামীণ জনসমষ্টিতে বংশানুক্রমে নেতৃত্ব লক্ষ্য করা যায়। অপরদিকে, শহর জনসমষ্টিতে দক্ষতা, যোগ্যতা এবং শিক্ষানুযায়ী নিজ নিজ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব গড়ে ওঠে।
৮. জনসংখ্যা : শহর জনসমষ্টিতে জন্মমৃত্যু হার গ্রামীণ জনসমষ্টির তুলনায় কম। গ্রামে একক পরিবারের পরিবর্তে যৌথ পরিবারের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। অপরদিকে, শহর জনসমষ্টিতে যৌথ পরিবারের তুলনায় একক পরিবারের প্রাধান্য বেশি পরিলক্ষিত হয়।
৯. বিবাহ : গ্রামীণ জনসমষ্টিতে বিবাহ একটি বড় ধরনের উৎসব। গ্রামে বিবাহ উৎসবে প্রতিবেশির ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া শহরের তুলনায় গ্রামে বহুবিবাহ বেশি। অপরদিকে, শহরে বিবাহ অনেকটা শুধুই পরিবার এবং নিকটাত্মীয় কেন্দ্রিক। এখানে পাড়া-প্রতিবেশির ব্যাপক উপস্থিতি খুব কমই লক্ষ্য করা যায়।
১০. শ্রম বিনিয়োগ : গ্রামীণ জনসমষ্টিতে শ্রম বিনিয়োগের প্রধান ক্ষেত্র কৃষি। শহরে শ্রম বিনিয়োগের বহুমুখী ক্ষেত্র লক্ষ্য করা যায়। গ্রামীণ জনসমষ্টিতে একের বিপদে অন্যরা এগিয়ে আসে। কিন্তু শহর জনসমষ্টিতে এ প্রবণতা খুব কমই লক্ষ্য করা যায়।
১১. বৈদ্যুতিক সুবিধা : গ্রামে তখনও সর্বত্র বৈদ্যুতিক সুবিধা পৌঁছানো সম্ভব হয় নি। তাছাড়া গ্রামে বৈদ্যুতিক লোডশেডিংও হয় খুবই ঘনঘন। অপরদিকে, শহরের সকল জনসমষ্টির মাঝে বিদ্যুতের সুবিধা পৌঁছেছে এবং এখানে লোডশেডিংও গ্রামের তুলনায় অনেক কম হয়।
১২. সামাজিক পরিবেশ : সংগত কারণেই শহরের জনসমষ্টির আর্থসামাজিক পরিবেশ গ্রামীণ জনসমষ্টির তুলনায় অনেক উন্নত । শহরের জনগণ গ্রামীণ জনগণের তুলনায় যাবতীয় সুযোগ সুবিধা অনেক বেশি পায়।
১৩. চিত্তবিনোদন : গ্রামীণ জনসমষ্টিতে চিত্তবিনোদনের তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই। কিন্তু শহর জনসমষ্টিতে চিত্তবিনোদনের নানারকম মাধ্যম যেমন- ক্লাব, পার্ক, থিয়েটার, জাদুঘর, সিনেমা হলের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
১৪. যোগাযোগ : শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত। ফলে শহরের জনগণ সহজেই প্রয়োজনে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করতে পারে। অপরদিকে, গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব একটা উন্নত নয়।
১৫. চিকিৎসা ব্যবস্থা : গ্রামীণ জনসমষ্টিতে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সুব্যবস্থা নেই বললেই চলে। অপরদিকে, শহর জনসমষ্টিতে আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা
বেশ উন্নত । এখানে বড় বড় ক্লিনিক, হাসপাতাল, ভালো ডাক্তার ইত্যাদির ব্যবস্থা রয়েছে।
১৬. হরতাল : শহর জনসমষ্টিতে হরতালের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। কারণ শহরকে কেন্দ্র করেই.হরতাল পরিচালিত হয়। তাছাড়া বিভিন্ন ধর্মঘট, অনশন ইত্যাদি শহরকেন্দ্রিক পরিচালিত হয়। কিন্তু গ্রামীণ জনগোষ্ঠীতে এগুলোর প্রভাব খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না।
১৭. যানজট : যানজট শহরের একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে এক ঘণ্টার পথ যেতে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। যানজট শহর জনসমষ্টির জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। কিন্তু গ্রামীণ জনসমষ্টিতে এ সমস্যা নেই।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার সমাপ্তি রেখা টানতে গিয়ে বলা যায় যে, গ্রামীণ শহর জনসমষ্টির কাঠামো, বিদ্যমান সুযোগ সুবিধা এবং বৈষম্য পর্যালোচনা করলে তাদের মাঝে কতিপয় পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্য সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে, যা উপরে আলোচনা করা হল। সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের স্বার্থেই এই পার্থক্য ও বৈসাদৃশ্য যতদূর সম্ভব দূর করার চেষ্টা
করা আজ সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।