অথবা, সমাজজীবনে সামাজিক দলের প্রয়োজনীতা আলোচনা কর?
অথবা, সমাজজীবনে সামাজিক দলের প্রভাব বিস্তারিত বর্ণনা কর?
অথবা, সমাজজীবনে সামাজিক দলের তাৎপর্য কী তা আলোচনা কর?
উত্তর৷ ভূমিকা : সমাজ হলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামাজিক দল দ্বারা গঠিত একটি বৃহত্তম সামাজিক সংগঠন। সমাজের প্রকৃতি ও স্বরূপ এবং ব্যক্তির সামাজিক জীবন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জন করতে হলে সামাজিক দলের বিশ্লেষণ একান্ত প্রয়োজন। কারণ সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তির সার্বিক কার্যাবলি সামাজিক দলের মধ্যেই সম্পাদিত হয়। ব্যক্তিমানুষের সামগ্রিক কার্যক্রমে দলীয় জীবনের অপরিসীম প্রভাব বিদ্যমান। মূলত দলীয় জীবনই ব্যক্তিমানুষকে সামাজিক জীবে পরিণত করে। এজন্য সামাজিক দল সমাজকর্মের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ব্যক্তিজীবনে ও সমাজজীবনে সামাজিক দলের গুরুত্ব : সমাজ হলো একটি বৃহত্তর জটিল সংগঠন যা ছোট ছোট সামাজিক দল বা গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। সমাজের প্রকৃতি ও স্বরূপ সম্পর্কে জানতে এবং ব্যক্তির সামাজিক জীবন সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে হলে সামাজিক দলের বিশ্লেষণ একান্ত প্রয়োজন। ব্যক্তি সমাজের সদস্য হলেও তাদের সার্বিক জীবনধারা সামাজিক দলের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সামাজিক দলই ব্যক্তির সার্বিক জীবনধারা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। এজন্য ব্যক্তিজীবনে ও সমাজজীবনে সামাজিক দলের গুরুত্ব অপরিসীম। নিচে ব্যক্তিজীবনে ও সমাজজীবনে সামাজিক দলের গুরুত্ব বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
১. সামাজিকীকরণে : ব্যক্তির সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে সামাজিক দলের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। পরিবার, খেলাধুলা ও
সমবয়সীদের সংস্থা, বিদ্যালয় প্রভৃতি সামাজিক দল এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ব্যক্তির সামাজিকীকরণে সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে প্রাথমিক দল। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক পি. জিসবার্ট (P. Gisbert) বলেছেন, “The primary or face to face group….. is the most effective agency of socialization.”
২. আদর্শ ও মূল্যবোধ শিক্ষা : সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধগত ধারণা বিকাশের ক্ষেত্রেও সামাজিক দলের ভূমিকা রয়েছে। সামাজিক দলগুলো সমাজ স্বীকৃত আচার আচরণ, আদবকায়দা, ন্যায় অন্যায় ও ঔচিত্য অনৌচিত্যের ধারণা প্রদান করে ব্যক্তিকে আদর্শবান হতে সাহায্য করে।
৩. সমাজের বিধিবিধান সম্পর্কিত জ্ঞানার্জন : সামাজিক দলগুলো ব্যক্তিকে সমাজের বিধিবিধান সম্পর্কে জ্ঞান দান করে। ফলে ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও তা কাজে লাগে।
৪. মুখচারিতা চরিতার্থ : মানুষ সামাজিক জীব। মুখচারিতা মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম। সামাজিক দলগুলো ব্যক্তির মুখচারিতা চরিতার্থকরণের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে।
৫. নেতৃত্বের বিকাশ : সমাজকে সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য নেতৃত্বের প্রয়োজন রয়েছে। আর নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে সামাজিক দল। শ্রমিক সংঘ, রাজনৈতিক দল, পরিবার, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে।
৬. মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ : মানুষের মৌল মানবিক প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রেও সামাজিক দলগুলোর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। পরিবার বা অন্যান্য সামাজিক দল যদি না থাকত তাহলে মানুষের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হতো না।
৭. সামাজিক নিরাপত্তা বিধান : সামাজিক নিরাপত্তার মূল কথা হলো অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রে সামাজিক দলগুলোর ভূমিকাই মুখ্য। অক্ষমতা, অসহায়ত্ব, বৃদ্ধকালীন সময়ে উপার্জনহীনতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও পরিবারের অর্থনৈতিক বা সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের নিশ্চয়তা প্রদান করে সামাজিক দল।
৮. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ : সামাজিক দলগুলো সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহন হিসেবে কাজ করে। সামাজিক দলগুলোর ব্যক্তি বা সামাজিক দলের সদস্যদের আচরণের একটা সীমারেখা অঙ্কন করে দেয়। ফলে ব্যক্তি বা সামাজি
ক দলের সদস্যরা একটা সামাজিক অনুশাসনের মধ্যে আবর্তিত হয়।এ
৯. মনস্তাত্ত্বিক গুরুত্ব : সামাজিক দলগুলো ব্যক্তি ও সমাজজীবনে যথেষ্ট মনস্তাত্ত্বিক কার্যাবলি সম্পাদন করে। এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। স্নেহ ভালোবাসা, মায়া-মমতা, আদর-সোহাগ, সহানুভূতি, সান্ত্বনা ইত্যাদি মানুষ পরিবার থেকে যত বেশি পায় অন্য কোন সামাজিক সংগঠন থেকে তা পায় না।
১০. সাহায্য সহযোগিতা : বিভিন্ন সামাজিক দল মানুষকে বিপদে আপদে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। এ সাহায্য ব্যক্তিগতভাবে মানুষ যেমন লাভ করতে পারে তেমনি দলীয়ভাবেও লাভ করতে পারে।
১১. সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ : ব্যক্তিমানুষের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রেও সামাজিক দলগুলোর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। সামাজিক দলগুলো মানুষের প্রতিভা ও সৃজনশীল ক্ষমতা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করে।
১২. অধিকার প্রতিষ্ঠা : ব্যক্তি ও দলীয় সদস্যদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও সামাজিক দলগুলোর ভূমিকা রয়েছে। শ্রমিক সংঘ, শিশু অধিকার ফোরাম, মহিলা আইনজীবী সমিতি এবং বিভিন্ন পেশাগত সংগঠন সামাজিক দলের অন্তর্ভুক্ত। এসব সামাজিক দলগুলো মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে।
১৩. সামাজিক সমস্যার সমাধান : মানবসমাজে নানারকম সামাজিক সমস্যা রয়েছে। তাছাড়া সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিবর্গের শরীর ও মনের ব্যাকুলতাও পরিলক্ষিত হয়। এসব প্রতিকূলতা বা সমস্যা দূরীকরণের ক্ষেত্রেও সামাজিক দলগুলোর ভূমিকা রয়েছে।
১৪. দায়িত্ব সম্পাদন : যে কোন দায়িত্ব সম্পাদনের ব্যাপারেও সামাজিক দলগুলো ব্যাপক ভূমিকা পালনে সহায়তা করে। সাধারণ অভিজ্ঞতার অংশীদার হিসেবে প্রাথমিক দলের সদস্যরা একযোগে কাজ করে। প্রাথমিক দলের সদস্যরা উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সাধারণত একই কার্যধারায় অংশগ্রহণ করে এবং পরস্পরের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে।
১৫. অভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধন : সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের জীবনে বহু অভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। এসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রাথমিক দলগুলো সদস্যদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা সজ্ঞায়িত করে। ব্যক্তিবর্গের মধ্যে এ বোধ সঞ্চারিত হয় যে, কোন উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে সে একেবারে একা নয়, তার পাশে আরো অনেকে আছে। এ চেতনা তাকে
ভূমিকা পালনে উজ্জীবিত করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্যক্তি ও সমাজজীবনে সামাজিক দলের গুরুত্ব ও
তাৎপর্য অপরিসীম। সামাজিক দলগুলো আছে বলেই ব্যক্তি সমাজে টিকে থাকতে পারে। সামাজিক দলগুলো আছে বলেই
মানুষ হিসেবে মানুষ তার অধিকার ভোগ করতে পারে। তাছাড়া সামাজিক দলগুলো মানুষকে সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও সামাজিক দলগুলোর ভূমিকা রয়েছে। সামাজিক দলগুলো মানুষকে তাদের অধিকার সচেতনতা ও রাজনৈতিক সচেতনতা দান করে। মানুষের জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ ও জীবনকে অর্থবহ করে তোলার ক্ষেত্রেও সামাজিক দলের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে।