সামাজিক দল বলতে কী বুঝ? সামাজিক দলের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।

অথবা, সামাজিক দলের সংজ্ঞা দাও। সামাজিক দলের বৈশিষ্ট্যাবলি আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক দল কী? সামাজিক দলের প্রকৃতি বর্ণনা কর।
অথবা, সামাজিক দল কাকে বলে? সামাজিক দলের মানদণ্ড আলোচনা কর।
উত্তর ভূমিকা : সমাজ হলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামাজিক দল দ্বারা গঠিত একটি বৃহত্তম সামাজিক সংগঠন। সমাজের প্রকৃতি ও স্বরূপ এবং ব্যক্তির সামাজিক জীবন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জন করতে হলে সামাজিক দলের বিশ্লেষণ একান্ত প্রয়োজন। কারণ সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তির সার্বিক কার্যাবলি সামাজিক দলের মধ্যেই সম্পাদিত হয়। ব্যক্তি মানুষের সামগ্রিক কার্যক্রমে দলীয় জীবনের অপরিসীম প্রভাব বিদ্যমান। মূলত দলীয় জীবনই ব্যক্তি মানুষের সামাজিক জীবে পরিণত করে। এজন্য সামাজিক দল সমাজকর্মের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সামাজিক দল : একটি বৃহত্তর সামাজিক সংগঠনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র একক হলো সামাজিক দল, যা দুই বা ততোধিক লোকের সমষ্টি। অন্যভাবে বলা যায়, সামাজিক দল বলতে এমন কতকগুলো লোকের সমষ্টিকে বুঝায় যারা কোন সাধারণ উদ্দেশ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়; কতকগুলো বিধিবিধানের অধীনে নিজেদেরকে আবদ্ধ। করে এবং দলীয় লক্ষ্যার্জনে সচেষ্ট হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সামাজিক দল সম্পর্কে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের প্রদত্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা প্রদান করা হলো :
সমাজবিজ্ঞানী জিসবার্ট (Gisbert) এর মতে, সামাজিক দল হলো ব্যক্তিবর্গের সমষ্টি, যারা স্বীকৃত সাংগঠনিক কাঠামোর অধীনে পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ায় নিয়োজিত থাকে। “Social group is a collection of individuals interacting on each other under a recognizable structure.”
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ম্যাকাইভার (MacIver) এবং পেজ (Page) এর মতে, “By a group we mean any collection of social being who enter into distinctive social relationships with one another. A
group, then as we understand it members.” উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সামাজিক দল বলতে কতকগুলো লোকের সমষ্টিকে বুঝায়, যারা কোন
সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে সংঘবদ্ধ হয়, নিজেদেরকে অন্যান্যদের থেকে আলাদা সত্তার অধিকারী মনে করে এবং নিজেদের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি মনস্তাত্ত্বিক ঐক্য ও আচরণবিধি তৈরি করে।
সামাজিক দলের বৈশিষ্ট্য : বৃহত্তর সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসেবে দলের কতকগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সার্বিকভাবে সামাজিক দলের বৈশিষ্ট্যাবলিকে আমরা নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করতে পারি :
১. একাধিক লোকের সমাবেশ : একাধিক লোকের সমাবেশ সামাজিক দলের সর্বপ্রথম উপাদান বা বৈশিষ্ট্য। কারণ একজন ব্যক্তি নিয়ে দল গড়ে উঠতে পারে না। দল গঠনের জন্য একাধিক লোকের সংঘবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। দলের আকার ছোটও হতে পারে আবার বড়ও হতে পারে। একটি সামাজিক দলে কতজন সদস্য থাকবে তা নির্ভর করে দল
গঠনের উদ্দেশ্য ও দলের প্রকৃতির উপর। যেমন- পরিবার হচ্ছে একটি সামাজিক দল। পরিবারের প্রকৃতি অনুযায়ী এর সদস্য সংখ্যা কম বেশি হতে পারে। বস্তুত একাধিক লোকের সমাবেশ যখন উদ্দেশ্য প্রণোদিত পারস্পরিক সম্পর্ক দ্বারা আবদ্ধ হয় তখন শুধু দল গঠিত হয়।
২. স্থায়িত্ব : সামাজিক দলের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর স্থায়িত্ব। কতকগুলো লোকের অস্থায়ী সমাবেশকে দল বলা যায় না। যেমন- খেলার মাঠে উপস্থিত জনসমাবেশ কিংবা বাসস্ট্যান্ডে উপস্থিত জনসমাবেশ। এসব জনসমাবেশ স্থায়ীভাবে কোন সংঘ গড়ে তুলতে পারে না। তাছাড়া অস্থায়ী জনসমাবেশ কোন সাধারণ লক্ষ্যার্জনের দিকেও ধাবিত হতে পারে না।
৩. অভিন্ন উদ্দেশ্য : সামাজিক দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দলের সদস্যরা একটি অভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনের দিকে ধাবিত হবে। সামাজিক দল উদ্দেশ্যবিহীন হতে পারে না। অভিন্ন উদ্দেশ্য বা সমস্বার্থ রক্ষাকল্পে সচেষ্ট হওয়া সামাজিক দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
৪. দলীয় ক্রিয়াপ্রত িক্রিয়া : দলীয় ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া সামাজিক দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। দলের প্রত্যেক সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া থাকাটাই স্বাভাবিক। পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া দলকে গতিশীল রাখে। এর উপর নির্ভর করে সদস্যদের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। এ সম্পর্ক যেমন সুমধুর হতে পারে তেমনি দ্বান্দ্বিকও হতে পারে ।
৫. দলীয় কাঠামো : প্রত্যেকটা সামাজিক দলের একটি দলীয় কাঠামো (Group Struccture) থাকে। দলীয় কাঠামো দলীয় সদস্যদের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। দলের স্থায়িত্ব দলীয় কাঠামোর উপর অনেকটাই নির্ভর করে।
৬. দলীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ : প্রত্যেকটি সামাজিক দলেরই দলীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ রয়েছে। দলের সদস্যরা এ আদর্শ ও মূল্যবোধ পরিপন্থি কোন কাজ করতে পারে না। দলীয় আদর্শ ও মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে দলীয় সদস্যদের পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া ও সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এ আদর্শ ও মূল্যবোধ সদস্যদের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
৭. সমবেত প্রচেষ্টা : দল গঠনের পিছনে থাকে অভিন্ন উদ্দেশ্য ও স্বার্থ। এ অভিন্ন উদ্দেশ্য পূরণ ও স্বার্থ সংরক্ষণ করাও একার পক্ষে সম্ভব নয়, বরং এর জন্য প্রয়োজন হয় দলীয় সদস্যদের সমবেত প্রচেষ্টা। সমবেত প্রচেষ্টা বা কার্যক্রম সামাজিক দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
৮. সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক : দলীয় সদস্যদের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। এ সম্পর্ক যত গভীর হয় দলের অস্তিত্বও তত স্থায়ী হয়। অন্যদিকে, এ অস্তিত্ব যত শীতল হয় দলের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সুতরাং দল গঠনের জন্য সদস্যদের মধ্যে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট পারস্পরিক সম্পর্ক থাকা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। দলীয় উদ্দেশ্য অর্জনকে কেন্দ্র করে সমস্যদের মধ্যে যে মিথস্ক্রিয়া সংগঠিত হয় তাতে দলীয় সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও পদমর্যাদা থাকতে হবে।
৯. দলীয় সচেতনতা : দলীয় সচেতনতা সামাজিক দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। দলের সাধারণ স্বার্থ, দলের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কার্যক্রম, আদর্শ ও মূল্যবোধ সম্পর্কে সকলকেই সচেতন হতে হয়। এছাড়া দলের অভ্যন্তরে যেসব সদস্য থাকে তারা সকলে সমান নয়। শিক্ষা, সামর্থ্য, যোগ্যতা, দক্ষতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে দলের সদস্যদের মধ্যে একটা পার্থক্য থাকে। দলীয় সদস্যরা এগুলো সম্পর্কেও সচেতন থাকে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সামাজিক দল সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামাজিক দলের সমন্বয়ে সমাজ গঠিত হয়। যখন কোন জনসমষ্টির বিভিন্ন অংশের মধ্যে সুস্পষ্ট সামাজিক সম্পর্ক থাকে। নিয়োজিত হয়, তখন সামাজিক দলের উদ্ভব ঘটে। আত্মা ছাড়া যেমন- দেহের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, তেমনি যায়। ব্যক্তি তথা সমাজজীবনে সামাজিক দলের গুরুত্ব অপরিসীম। সামাজিক দল ছাড়াও সমাজ তথা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। সমাজে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক দল লক্ষ্য করা।