ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা নির্ণয় বলতে কী বুঝ? গতিশীল সমস্যা নির্ণয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর ।

অথবা, ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় বলতে কী বুঝ? সমস্যা নির্ণয়ে গতিশীল প্রক্রিয়া সম্পর্কে তোমার ধারণা উল্লেখ কর।
উত্তর ভূমিকা : ব্যক্তি সমাজকর্ম অনুশীলন প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হলো মনোসামাজিক সমস্যা নির্ণয়। এ পর্যায়ে মনোসামাজিক অনুধ্যানের মাধ্যমে সংগৃহীত বিভিন্ন তথ্যের প্রেক্ষিতে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি বা সাহায্যার্থীরস্বরূপ ও প্রকৃতি নির্ণয় করা। এছাড়া সমস্যার সঠিক ও যথার্থ স্বরূপ ও প্রকৃতি নির্ণায়ন সমাধান পরিকল্পনা তৈরিতে দিকনির্দেশকের ভূমিকা পালন করে। মূলত ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যার স্বরূপ নির্ণয়ের অনুশীলন করা হয় যখন কোন সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি সমস্যা সমাধানের জন্য সমাজকর্ম প্রতিষ্ঠানে আগমন করে এবং ব্যক্তিকে সাহায্য করার উপায় বা সমাধান পরিকল্পনা সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছানো এবং বাস্তবায়ন পরবর্তী পর্যায়েও অর্থাৎ সার্বিক সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার শেষ পর্যন্ত এ প্রচেষ্টা চলতে থাকে। সমস্যা নির্ণয় (Diagnosis or assessment) : সমাজকর্ম প্রক্রিয়ায় আভিধানিক অর্থে সমস্যার স্বরূপ নির্ণয়
হচ্ছে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি বা সাহায্যার্থীর ব্যক্তিত্ব ও তার মনোসামাজিক অবস্থা বা সমস্যার সঠিক সংজ্ঞায় পৌঁছার এক নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস। এ বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে হলে এরূপ বলা যায় যে, এটি এক সচেতন মানসিক কর্মপ্রয়াস যাতে সাহায্যার্থী ব্যক্তির সার্বিক ধারণা, স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান, অনুমান, অন্তর্দৃষ্টি ও তার অসম্পূর্ণ চিন্তাভাবনা ইত্যাদি অত্যন্ত শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে গুছিয়ে তার সমস্যার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।
সাধারণভাবে বলা যায়, ব্যক্তি সমাজকর্মে Diagnosis বা সমস্যা নির্ণয় হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে সাহায্যার্থীর সমস্যা সম্পর্কিত প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে ব্যক্তির সমস্যা, সামাজিক অবস্থা এবং ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয় বা সমস্যা সমাধান কার্যক্রমের রূপরেখা প্রণয়নে অবদান রাখে ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্নভাবে বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও সংস্থা এ বিষয়ে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি সংজ্ঞা দেয়া হলো :
The Dictionary of Social Welfare এর প্রদত্ত সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “সমস্যা নির্ণয় হলো ক্লায়েন্টের ব্যক্তিত্ব এবং তার সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে যথাযথভাবে সঠিক সংজ্ঞায়ন।” The Dictionary of Social Work “Diagnosis is the process of identifying a problem (social and mental as well as medical) and its underlying causes and formulatiting a
solution.” অর্থাৎ, সমস্যা নির্ণয় হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সমস্যা নির্ধারণ (সামাজিক, মানসিক ও চিকিৎসা) ও তার কারণ চিহ্নিতকরণ এবং সমাধান পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় Diagnosis বা সমস্যা নির্ণয় হলো এমন
একটি মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা যার জন্য সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি তার সমস্যা এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে সমস্যার যথার্থ স্বরূপ, প্রকৃতি এবং তার সমাধান পরিকল্পনা বা নকশা সম্পর্কে এক স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়।
গতিশীল সমস্যা নির্ণয় প্রক্রিয়া : ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় সমাধানমূলক কর্ম প্রয়াসকে সাধারণভাবে তিনটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায়। যথা :
১. সমস্যা নির্ণয়ে গতিশীল প্রক্রিয়া,
২. সমস্যা নির্ণয়ে যান্ত্রিক বা চিকিৎসামূলক প্রক্রিয়া এবং
৩. সমস্যা নির্ণয়ে ঐতিহাসিক বা উৎপত্তি সম্বন্ধীয় প্রক্রিয়া।
নিম্নে সমস্যা নির্ণয়ে গতিশীল প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. সমস্যা নির্ণয়ে গতিশীল প্রক্রিয়া : সমস্যা নির্ণয়ে গতিশীল প্রক্রিয়া (Dynamic process) হচ্ছে ব্যক্তি যে সমস্যায় নিপতিত হয়েছে সে অবস্থায় যে সমস্ত বি ষয় বা শক্তিসমূহ পরস্পর ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ায় সক্রিয় রয়েছে তার একটি সামগ্রিক চিত্র দাঁড় করানো ও সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা। ঐ সমস্ত বিষয়ের প্রভাব বর্তমানে ব্যক্তির মানস
কাঠামোতে ও সে যে সামাজিক অবস্থার মধ্যে আছে তাতে এবং সর্বোপরি নিজ পরিবেশের মধ্যে সেগুলো কিভাবে ও কতটুকু ক্রিয়াশীল রয়েছে তা নির্ণয় করতে সচেষ্ট হওয়া। অর্থাৎ গতিশীল ডায়াগনসিসে সাহায্যার্থীর সমস্যা পরিস্থিতির সাথে মিথস্ক্রিয়াগত শক্তিসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক ধারা নিরূপণ করা হয়। পার্লম্যানের ভাষায়- The dynamic
diagnosis is a kind of cross-sectional view of the forces interacting in the client problem situation. এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূলত নিম্নোক্ত বিষয়গুলো তার উপর গুরুত্ব দিয়ে তা উদ্ঘাটন করতে তৎপর হতে হয়।
১. মূল অসুবিধা কি? কি কি মানসিক, পারিবারিক অথবা সামাজিক বিষয় সমস্যাটির জন্ম দিয়েছে?
২. ব্যক্তির কল্যাণ ও সাথে সাথে অন্যের জীবৃনে বা কল্যাণে সমস্যাটি কি প্রতিকূল প্রভাব বিস্তার করছে?
৩.ব্যক্তি তার সমস্যার কিরূপ সমাধান চায়?
৪. সমাধানের ব্যাপারে ব্যক্তি ও তার পরিবেশের মধ্যে কি কি উপায় বা অনুকূল অবস্থা বর্তমান এবং কি কি সম্পদ ও কিভাবে সাহায্য কর্মসূচি প্রণয়ন দরকার যা দ্বারা সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। সাধারণভাবে সমস্যা নির্ণয় প্রক্রিয়ায় যেসব পর্যায়ক্রমিক পদক্ষেপ রয়েছে গতিশীল সমস্যা নির্ণয় প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে অগ্রসর হতে হয়। তবে অন্যান্য প্রক্রিয়ার সাথে এর মূল পার্থক্য হলো তাতে সমস্যার উদ্ভব
বিকাশ ধারার একটি ধারাবাহিক বিবরণ তৈরি না করে সমস্যাকে কতিপয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করার রীতিবদ্ধ প্রয়াস না চালিয়ে সমস্যা পরিস্থিতিকে ব্যক্তির নিজস্ব ও পরিবেশগত বিভিন্ন ক্রিয়াশীল শক্তি উপাদানের মিথস্ক্রিয়া ব্যাখ্যা করে সমাধান পরিকল্পনা গ্রহণ করা। ফলে তা একদিকে যেমন পরিবর্তনশীল বাস্তবতা সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় করে; অন্যদিকে তেমন কাঙ্ক্ষিত ও সম্ভাব্য সম্পর্ক সামর্থ্যের আলোকে সমাধান পন্থা নির্দিষ্ট করে। সামগ্রিক দিক থেকে গতিশীল সমস্যা নির্ণয়
প্রক্রিয়া উপরে আলোচিত প্রকৃতি লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও বিবেচ্য বিষয়াদির আলোকে নিম্নরূপ পর্যায়ক্রমিক কর্মধারায় ব্যাপ্ত হয়।
ক. পারস্পরিক সম্পর্ক সূত্রে মনোসামাজিক তথ্যাদির বিশ্লেষণ : মনোসামাজিক অনুখ্যানে প্রাপ্ত তথ্যাদির মধ্যে ব্যক্তির কোন মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক উপাদানের মিথস্ক্রিয়ায় কিরূপ সমস্যার উদ্ভব বিস্তার ঘটেছে, ব্যক্তি এমন অবস্থায় কি ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়েছে ও সমাধান প্রত্যাশা করছে এবং শক্তি-সামর্থ্য ও সমর্থন আয়োজনের কতটা ব্যবস্থা করা যায়।
ইত্যাদি নির্ধারণ হলো বিশ্লেষণের কাজ। এ ধরনের বিশ্লেষণে তথ্যাদিকে বৈশিষ্ট্যগত দিক বিবেচনায় সাজিয়ে নিতে হয় এবং সে আলোকে প্রস্থচ্ছেদমুখিতায় বিভিন্ন পারস্পরিক ক্রিয়াশীল উপাদানের সম্পর্ক খুঁজে সমস্যার কারণ, স্বরূপ ও প্রকৃতি উদ্ঘাটন করতে হয়।
খ. সমস্যার বিস্তার ধারা দেখে বিভিন্ন মানগত অবস্থার সাথে সম্পর্ক স্থাপন : এ পর্যায়ে সমস্যা কোন কোন উপাদানের ক্রিয়াশীলতা কোন কোন দিকে বিস্তৃত হয়েছে তা নিরূপণ হয়। তারপর সে প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সেবা সুবিধার মানগত অবস্থার মধ্যে বিস্তারের পর্যায়কে সম্পর্কযুক্ত করতে হয়।
গ. সেবা সুবিধার প্রেক্ষিতে সমস্যার শ্রেণিবিন্যাস : এক্ষেত্রে সমাধানমূলক ব্যবস্থার সুযোগ সুবিধা ও ব্যক্তির শক্তি সামর্থ্যের আলোকে সমস্যার শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। এরূপ শ্রেণিবিন্যাস সাধারণত বর্ণনামূলক হয়ে থাকে। তাতে ব্যক্তি আচরণের লক্ষণ ও বিভিন্ন সেবা সুবিধা প্রাপ্তির ধরন বিবেচনায় আসে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সমস্যাগত ব্যক্তি যিনি এজেন্সি বা সমাজকর্মীর নিকট পেশাগত সাহায্যের জন্য আসেন তাকে জানার ও বুঝার মাধ্যম হলো তার আচরণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তগুলোর অর্থ অন্বেষণ করা। তার
ধ্যানধারণা, আচার আচরণ, আবেগ অনুভূতি, দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিটি দিকই সমস্যা নির্ণয়ে বিশেষ অর্থ বহন করে। এরূপ গতিময় আচার আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির সমস্যা নির্ণয় প্রক্রিয়া সদা পরিবর্তিত হয়। তাই এক্ষেত্রে গতিশীল প্রক্রিয়া সমস্যা নির্ণয়ে ভূমিকা পালন করে