ব্যক্তি সমাজকর্ম কী? ব্যক্তি সমাজকর্মে গ্রহণনীতি ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যীকরণ নীতির গুরুত্ব বুঝিয়ে বল ।

অথবা, ব্যক্তি সমাজকর্ম কাকে বলে? ব্যক্তি সমাজকর্মে গ্রহণনীতি ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যীকরণ নীতির তাৎপর্যন্ত বর্ণনা কর।
অথবা, ব্যক্তি সমাজকর্ম বলতে কী বুঝ? ব্যক্তি সমাজকর্মে গ্রহণনীতি ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সমাজকর্ম অনুশীলনের ঐতিহ্যগত পদ্ধতি হলো ব্যক্তি সমাজকর্ম। এর মাধ্যমে সেবাগ্রহীতার সুপ্ত প্রতিভা ও সম্ভাবনা বিকাশের মাধ্যমে সামাজিক ভূমিকা পালন, ক্ষমতার পুনরুদ্ধার, উন্নয়ন এবং সংরক্ষণের প্রচেষ্টা চালানো হয়। ব্যক্তি সমাজকর্ম সমাজকর্যের একটি মৌলিক পদ্ধতি। সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সাহায্য করার জন্য পেশাদার সমাজকর্মীগণ যে পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে থাকেন তাই হলো ব্যক্তি সমাজকর্ম। ব্যক্তি সমাজকর্মের মুখ্য উপাদান হলো ব্যক্তি।
ব্যক্তি সমাজকর্মে গ্রহণনীতির গুরুত্ব : ব্যক্তি সমাজকর্মের নীতি হলো গ্রহণনীতি। এ নীতির মূল কথা হলো সমাজকর্মী তার নিকট আগত সাহায্যার্থীকে উষ্ণ আন্তরিকতা ও মর্যাদার সাথে গ্রহণ করবে। সমাজকর্মী যদি সাহায্যার্থীকে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ না করে তাহলে ব্যক্তি সমাজকর্মের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই ব্যাহত হতো। বিভিন্ন কারণে ব্যক্তি সমাজকর্মে গ্রহণনীতি গুরুত্ব বহন করে। নিম্নে এর গুরুত্ব বর্ণনা করা হলো।
১. মানসিক শক্তি সঞ্চার : গ্রহণনীতির কারণে একজন সাহায্যার্থী প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুটা হলেও মানসিক শক্তি সঞ্চার করতে পারে। কেননা সমাজকর্মীর সাথে প্রথম পরিচয় কিংবা সাক্ষাৎ পর্বে সাহায্যার্থী ব্যক্তি কমবেশি যাতনাদায়ক পরিস্থিতি ও বায়ুর চাপজনিত কারণে হতাশাগ্রস্ত কিংবা মানসিকভাবে দুর্বল ও অস্থির থাকে। কিন্তু পেশাদার সমাজকর্মী
তার পেশাগত স্বার্থেই সাহায্যার্থীকে সহজভাবে গ্রহণ করে তার প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাব প্রদর্শন করেন। এতে সাহায্যার্থীর মানসিক শক্তি সঞ্চারের পথ প্রশস্ত হয়।
২. ভয়ভীতি দূর হয় : সমাজকর্মী সাহায্যার্থীকে সহজভাবে গ্রহণ করার ফলে এ দু’জনের মধ্যে যে সহযোগিতামূলক মনোভাবের সৃষ্টি হয় তাতে সাহায্যার্থীর হতাশা, ভয়ভীতি, মানসিক চাপ ও অস্থিরতা অনেকটাই কমে যায়। ফলে
সাহায্যার্থী অনেকটা স্বস্তি ও স্বাভাবিকতা ফিরে পায়।
৩. পরস্পরকে গ্রহণ করার সুযোগ গ্রহণ (Acceptance) একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে সমাজকর্মী যেমন সাহায্যার্থীকে তার সেবাপ্রদানের লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করে, তেমনি সাহায্যার্থীও সমাজকর্মীকে তার সমস্যা সমাধানের একজন উপযুক্ত মাধ্যম বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করে।
৪. সমস্যার প্রাথমিক মূল্যায়ন : গ্রহণনীতির মাধ্যমে একজন সমাজকর্মী সাহায্যার্থীর সমস্যার প্রাথমিক ধারণা লাভ করতে সক্ষম হন এবং সে অনুযায়ী সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
৫. পেশাগত সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন : একজন পেশাদার সমাজকর্মী তার জ্ঞান, দক্ষতা ও নৈপুণ্যতার আলোকে সাহায্যার্থীকে সহজভাবে গ্রহণ এবং যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করেন। পেশাগত স্বার্থে তিনি সাহায্যার্থীকে আপন করে নেয়ার চেষ্টা ও মনোযোগ আকর্ষণ করেন। তিনি সাহায্যার্থীর অনুভূতির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ এবং তাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন
করেন। সাহায্যার্থীও এক্ষেত্রে সমাজকর্মীর অনেকটা কাছে আসার চেষ্টা করেন। এভাবে গ্রহণনীতির মাধ্যমে সমাজকর্মীর সাথে সাহায্যার্থীর পেশাগত সম্পর্কের (Rapport) ভিত্তি স্থাপিত হয়।
৬. সমাজকর্মী ও সাহায্যার্থীর দূরত্ব হ্রাস : সমাজকর্মী এবং সাহায্যার্থীর মর্যাদা, চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদির মধ্যে যে দূরত্ব থাকে তা দূরীকরণের শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে গ্রহণনীতি। এর মাধ্যমে একজন একটি সমাজকর্মী সাহায্যকর্মীর আরও কাছাকাছি আসতে পারে।
৭. সমাজকর্মীর জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয ়োগের সুযোগ : সাহায্যার্থীকে গ্রহণ করা এবং সমাজকর্মীকে সাহায্যার্থীর বিশ্বাস স্থাপনের ফলে সমাজকর্মী তার জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, নৈপুণ্যতা ও কলাকৌশল প্রয়োগের সুযোগ লাভ করেন। উপরিউক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও আমরা বলতে পারি, সমাজকর্মীর গ্রহণনীতির উপর ভিত্তি করেই ব্যক্তি সমাজকর্মে ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের ভিত রচিত হয়। এর মাধ্যমেই সমাজকর্মী এবং সাহায্যার্থীর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপিত হয় এবং
তারা পরস্পরের নিকট স্থান করে নিতে সমর্থ হয়
ব্যক্তি সমাজকর্মে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যীকরণ নীতির গুরুত্ব : ব্যক্তি সমাজকর্মের গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যীকরণ নীতি । নিম্নে ব্যক্তি সমাজকর্মে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যীকরণ নীতির গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
১. সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা : ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যীকরণ নীতি ব্যক্তিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা প্রদান করে থাকে।
এক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেই নিজের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারপ্রাপ্ত হয়। যেহেতু সমস্যাটি ব্যক্তির
নিজের তাই সমস্যা সমাধানে তার মতামতই প্রাধান্য পাবে।
২. ব্যক্তিস্বাধীনতার মর্যাদা : প্রত্যেক ব্যক্তির রয়েছে ব্যক্তিস্বাধীনতা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রীকরণ নীতি চর্চার মধ্যে ব্যক্তির ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষিত হয়। ব্যক্তির ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষিত না হলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জাগ্রত হবে না। ব্যক্তি সমাজকর্ম ব্যক্তির স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে এবং তার মর্যাদা দেয়।
৩. ব্যক্তির আত্মপ্রত্যয় : সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সাহায্যার্থীর আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাস জাগ্রতকরণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যীকরণ নীতির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কারণ সমস্যা সমাধানে ব্যক্তির দৃঢ় মনোবল থাকতে হবে এবং তাকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে না পারলে তাকে সমস্যার মধ্য থেকে বের করে আনা যাবে না।
৪. সাহায্যার্থীর মর্যাদা সংরক্ষণ : আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার সাহায্যার্থীর আত্মমর্যাদাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। সাহায্যার্থী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় বলে নিজেকে মর্যাদাবান মনে করে। এতে তার ভিতর আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হয়। এবং এক্ষেত্রে সমাজকর্মী সাহায্যার্থীকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা প্রদান করার চেষ্টা করে।
৫. সমস্যার সহজ সমাধান : আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার নীতির চর্চা আছে বলেই ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যার সমাধান সহজ হয়। এর কারণ সাহায্যার্থী ব্যক্তি এক্ষেত্রে নিজেই সমস্যা সমাধানের রূপরেখা প্রণয়নে সহায়তা করতে পারে। এবং সমস্যার সহজ সমাধানে পৌঁছাতে পারে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, ব্যক্তি সমাজকর্মে গ্রহণনীতি ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রীকরণ নীতি এ দুটির কোনটিরই গুরুত্ব কম নয়। সাহায্যার্থীর ভয়ভীতি দূর করে সাহায্যার্থী ও সমাজকর্মীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রচনা, সাহায্যার্থীর সাময়িক মানসিক তৃপ্তি লাভ, পেশাগত সম্পর্ক স্থাপনের ভিত্তি স্থাপন ইত্যাদি ক্ষেত্রে গ্রহণনীতির গুরুত্বকে অস্বীকার করার
কোন উপায় নেই। আবার ব্যক্তি সমাজকর্মে ব্যক্তি সমাজকর্মের গুরুত্বও কম নয়। এ প্রসঙ্গে এফ. পি বিসটেক বলেন, “Individualization is based upon the right of human beings to be individuals and to be treated not just a human beings but this human with personal differences.”