ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদানগুলো কী কী? ব্যক্তি সমাজকর্মের অনুশীলনে উপাদানগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্ব আলোচনা কর।

অথবা, ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদানসমূহ কী কী? উপাদানসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের মানুষের বহুমুখী মনোসামাজিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে আধুনিক সমাজকল্যাণ বা পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশ ঘটে। আর পেশাদার সমাজকর্মের সূত্রপাত মূলত ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত, মনোসামাজিক সমস্যাকে ঘিরে। ব্যক্তির এ সমস্যা মোকাবিলার লক্ষ্যে সমাজকর্মের একটি মৌলিক পদ্ধতি হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্মের উদ্ভব, বিকাশ ও অনুশীলন হয়। বিভিন্ন মনীষী ব্যক্তি সমাজকর্মকে তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
ব্যক্তি সমাজকর্মের মানদণ্ডসমূহ কী কী? মানদণ্ডসমূহের মধ্যে প পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচনা কর।
ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদান : সমাজকর্মের অন্যান্য পদ্ধতির মতো ব্যক্তি সমাজকর্মের কতিপয় উপাদান রয়েছে। যেসব উপাদানকে কেন্দ্র করে ব্যক্তি সমাজকর্মের পদ্ধতি প্রয়োগ/অনুশীলন/পরিচালনা করা হয়, সেসব উপাদান বা উপকরণকে ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদান বলা হয়। ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদান সম্পর্কে H. H. Perlman এর বক্তব্যে
একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, “A person with problem comes to a place where a professional representative helps him by a given process.” পার্লম্যানের এ বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করলে ব্যক্তি সমাজকর্মের মোট পাঁচটি উপাদান পাওয়া যায় এবং এ উপাদানগুলোই বর্তমান ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদান হিসেবে
পরিচিত। উপাদানগুলো হলো :
১. ব্যক্তি (Person),
২. সমস্যা (Problem),
৩. স্থান (Place),
৪. পেশাগত প্রতিনিধি (Professional representative),
৫. প্রক্রিয়া (Process), সংক্ষেপে একে 5-Ps ও বলা হয়।
১. ব্যক্তি (Person) : ব্যক্তি বলতে এখানে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিকে (সাহায্যপ্রার্থীকে) বুঝানো হয়েছে। যে নিজে নিজের সামর্থ্য ও দূরদর্শিতা দ্বারা সমস্যা সমাধানে অক্ষম।
২. সমস্যা (Problem) : সমস্যা হলো এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা বা অসুবিধা। যা ব্যক্তিকে (সাহায্যপ্রার্থীকে) আক্রান্ত করেছে এবং ব্যক্তির অভ্যন্তরে এক ধরনের পীড়নমূলক অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
৩. স্থান (Place) : স্থান বলতে এখানে পেশাগত সেবাদানের জন্য নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানকে বুঝানো হয়। সেখানে বসে সমাজকর্মী সাহায্যপ্রার্থীকে বস্তুগত ও অবস্তুগত সাহায্য ও সহায়তা দিয়ে থাকেন।
৪. পেশাগত প্রতিনিধি (Professional representative) : পেশাগত আর কেউ নন, তিনি হলেন সমাজকর্মী। যিনি কোন প্রতিষ্ঠানের অধীনে একজন পেশাদার প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
৫. প্রক্রিয়া (Process) : প্রক্রিয়া হলো কতকগুলো ধারাবাহিক কার্যক্রম যা প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তি সমাজকর্মী ব্যক্তিকে সমস্যা মোকাবিলায় সক্ষম করার প্রচেষ্টা চালান।
জানী ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদানগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্ব : ব্যক্তি সমাজকর্ম বলতে আসলে ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদানসমূহের পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াকেই বুঝায়। এ উপাদানগুলো তাই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও নির্ভরশীল। নিম্নে ব্যক্তি সমাজকর্মের পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
১. ব্যক্তির (সাহায্যার্থীর) সাথে সমাজকর্মীর সম্পর্ক : ব্যক্তি সমাজকর্ম একজন সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিকে (সাহায্যার্থীকে) কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। এখানে ব্যক্তি যদি না থাকত তাহলে ব্যক্তি সমাজকর্মের প্রশ্নই আসত না। আবার বক্তি বা সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি থাকলেই ব্যক্তি সমাজকর্ম হবে না, তাকে তার যাতনা উপশম বা নিরসনকল্পে অবশ্যই একজন ব্যক্তি সমাজকর্মীর কাছে যেতে হবে। তাই দেখা যায় সাহায্যার্থীর সাথে ব্যক্তি সমাজকর্মীর একটি যৌক্তিক সম্পর্ক থাকবে।
২. ব্যক্তির সাথে সমস্যার সম্পর্ক : একজন ব্যক্তি তখনই ব্যক্তি সমাজকর্মীর দ্বারস্থ হবেন যখন সাহায্যার্থী সমস্যাগ্রস্ত হবেন। অর্থাৎ সমস্যায় আক্রান্ত না হলে সেবা গ্রহণের প্রশ্ন আসে না। এখানে দেখা হয় সমস্যা ব্যক্তির জীবনে কিভাবে, কতটা এবং কোন মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করছে। তাই ব্যক্তি ও সমস্যার সম্পর্ক নির্ণয় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
৩. ব্যক্তির সাথে প্রক্রিয়া : ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের জন্য একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আবার এ প্রক্রিয়াগুলোই ব্যক্তির সমস্যা মোকাবিলার বা সমাধানের জন্য প্রণীত।
৪. ব্যক্তির সাথে প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক : সাহায্যার্থী ব্যক্তির সাথে (সেবাদানকারী) প্রতিষ্ঠানের একটা সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এক্ষেত্রে অবশ্য ব্যক্তি সমাজকর্মী সাহায্যার্থীকে (ব্যক্তিকে) সহায়তা করেন।
৫. সমস্যার সাথে সমাজকর্মীর সম্পর্ক : ব্যক্তি সমাজকর্মীকে অবশ্যই সমস্যার ধরন, কারণ, প্রভাব ইত্যাদি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অধিকারী হতে হয়। ব্যক্তি সমাজকর্মীকে ব্যক্তির মনোসামাজিক সমস্যা সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও দক্ষ হতে হয়।
৬. সমস্যার সাথে প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক : সমস্যার সাথে প্রতিষ্ঠানের একটা সম্পর্ক রয়েছে। কারণ ব্যক্তি সমাজকর্ম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ মূলত একই জাতীয় বা সমধর্মী সমস্যা মোকাবিলায় নিয়োজিত ।
৭. সমস্যার সাথে প্রক্রিয়ার সম্পর্ক : ব্যক্তি যেসব সমস্যায় আক্রান্ত হয় তা মোকাবিলার লক্ষ্যে কতকগুলো প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। সমস্যার ধরনের উপর সমাধান প্রক্রিয়া নির্ভরশীল।
৮. ব্যক্তি সমাজকর্মীর সাথে প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক : ব্যক্তি সমাজকর্মী মূলত কোন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যক্তির জন্য কাজ করেন।
৯. ব্যক্তি সমাজকর্মীর সাথে প্রক্রিয়ার সম্পর্ক : ব্যক্তি সমাজকর্মীকে নির্বাচন ও সাহায্যার্থীর প্রয়োজনে উপযুক্ত সমাধান প্রক্রিয়া নির্বাচনও করতে হয়।
১০. প্রক্রিয়ার সাথে প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক : সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সেবাদান প্রক্রিয়ার একটি সম্পর্ক রয়েছে। কারণ প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত কিছু সেবাদান প্রক্রিয়ায় তাদের প্রতিষ্ঠানে আগত সাহায্যার্থীকে সেবা দিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানভেদে অনেক সময় প্রক্রিয়াগত হেরফের হয়ে থাকে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা থেকে একথা বলা যায়, ব্যক্তি সমাজকর্ম ব্যক্তির মনোসামাজিক সমস্যা মোকাবিলায় নিয়োজিত একটি পদ্ধতি। এ পদ্ধতির রয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু উপাদান। সেবাদান প্রক্রিয়ায় এসব উপাদানগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের সাথে প্রভাব বিদ্যমান। যে কোন সেবাদান প্রক্রিয়ায় এসব উপাদানসমূহের গুরুত্ব
নির্ধারণ করে পারস্পরিক সম্পর্ক যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে ব্যক্তি সমাজকর্মের লক্ষ্যার্জন সহজতর করা সম্ভব বলে আমাদের বিশ্বাস।