বাংলাদেশে ব্যক্তি সমাজকর্মের প্রয়োগক্ষেত্রগুলো আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশে ব্যক্তি সমাজকর্মের পরিধি আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে ব্যক্তি সমাজকর্মের অনুশীল আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে ব্যক্তি সমাজকর্মের পরিসীমা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : পেশাদার সমাজকর্মের একটি সহায়ক পদ্ধতি হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্ম ব্যক্তির সমস্যার প্রতিকারধর্মী কর্মতৎপরতায় লিপ্ত। মূলত শিল্পবিপ্লবোত্তর জটিল সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির মনোসামাজিক সমস্যা মোকাবিলার লক্ষ্যে ব্যক্তিকে সাহায্য করা হয় ব্যক্তি সমাজকর্মে এবং ব্যক্তি সমাজকর্মের প্রয়োগ ও অনুশীলন তাই শিল্পায়িত সমাজব্যবস্থায় বহুল লক্ষণীয়। তবে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশেও ব্যক্তি সমাজকর্ম অনুশীলনের যথেষ্ট সুযোগ বিদ্যমান।
বাংলাদেশে ব্যক্তিসমাজকর্ম অনুশীলনের প্রয়োগক্ষেত্র বা পরিধি : নিম্নে বাংলাদেশে ব্যক্তিসমাজকর্ম অনুশীলনের প্রয়োগক্ষেত্র বা পরিধি আলোচনা করা হলো :
১. চিকিৎসা সমাজকর্ম : চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিভিন্ন উন্নত দেশে একটি সাহায্যকারী পেশা হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্মের অনুশীলন করা হয়। আমাদের দেশেও হাসপাতালগুলোতে সেবা ব্যবস্থা আরও বেশি গতিশীল করার জন্য ব্যক্তি সমাজকর্ম অনুশীলন করা যেতে পারে। চিকিৎসা সমাজকর্ম একটি দলীয় প্রক্রিয়া। এখানে বিশেষ ডাক্তার, মনোচিকিৎসক,
মনোবিজ্ঞানী, ব্যক্তি সমাজকর্মী এদের সমন্বয়ে রোগীর মনোদৈহিক, সামাজিক কল্যাণ আনয়নের চেষ্টা করা হয়। যদিও দেশে কিছু হাসপাতালে চিকিৎসা সমাজকর্মী রয়েছে তবে তা খুবই নগণ্য। তাই দেশের সকল হাসপাতালে চিকিৎসা সমাজকর্মী হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্মের পর্যাপ্ত অনুশীলন আবশ্যক।
২. স্কুল সমাজকর্ম : আমাদের দেশে বিদ্যালয়গুলোতে ব্যক্তি সমাজকর্ম অনুশীলনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কারণ
স্কুলে আগত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নানাবিধ সমস্যা যেমন পড়াশোনায় অমনোযোগিতা, বিদ্যালয় থেকে পলায়ন, পরীক্ষায় নকল, স্কুলে নিয়মিত না আসা ইত্যাদি সমস্যা ও তার কারণ উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে স্কুল সমাজকর্ম পদই প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। তাছাড়া শিক্ষার বৃহত্তর লক্ষ্যে স্কুলের প্রশাসন, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে একটি স্বাস্থ্যকর শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যক্তি সমাজকর্মী একজন বিদ্যালয় সমাজকর্মী হিসেবে পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করতে পারেন।
৩. সংশোধনমূলক কার্যক্রম : শাস্তি মানুষের মধ্যে নেতিবাচক অনুভূতির জন্ম দেয়। ফলে ব্যক্তির অপরাধের মধ্যে ধ্বংসাত্মক প্রবণতা সৃষ্টি হয়, যা তাকে পুনরায় অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করে। অপরাধী একজন মানুষ। আর তাই সংশোধনমূলক পদ্ধতিতে একজন অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে তার কৃতকর্মের জন্য অপরাধবোধ জাগ্রত করার
মাধ্যমে তাকে ঐসব অপরাধমূলক কাজ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। আমাদের দেশে দেখা যায় অনেক অপরাধী হয়ত প্রথমবারের মতো অপরাধ করল। অথবা অল্প বয়স্ক কিশোর-কিশোরীরা অনেক সময় অপরাধ সৃষ্টিমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। এসব প্রাথমিক এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক অপরাধীদের সংশোধনের জন্য আলোচ্য পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৪. শিশু কল্যাণের ক্ষেত্রে : শিশুরা একটি জাতির ভবিষ্যৎ। তাই শিশুদের যথাযথভাবে বৃদ্ধিও নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের দেশে যেসব শিশু সদন, শিশু নিবাস, শিশু সংগঠন রয়েছে সেক্ষেত্রে ব্যক্তি সমাজকর্ম অনুশীলনের সুযোগ রয়েছে। কারণ দেখা যায় এসব জায়গায় লালিত শিশুদের মধ্যে সকলে একই তালে চিন্তাচেতনা, জ্ঞানবুদ্ধির দিক
থেকে বেড়ে উঠতে পারে না। ফলে এসব শিশুদের ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যক্তি সমাজকর্মী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
৫. পরিবার কল্যাণ : বর্তমান শিল্পায়িত শহুরে সমাজে ব্যক্তিকে বিভিন্ ন ধরনের মানসিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি বহুল প্রচলিত। তাছাড়া আমাদের দেশেও বর্তমান শহুরে সমাজে পারিবারিক পর্যায়ে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যা; যেমন স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিত্বের সংঘাত, বিবাহবিচ্ছেদ, পারিবারিক ভাঙন, বার্ধক্য ইত্যাদি সমস্যা সমাধানে এ
পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। আবার পারিবারিক ভাঙনের ফলে শিশুদের নিরাপত্তাজনিত দিকটি নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রেও ব্যক্তি সমাজকর্ম পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বাংলদেশে ব্যক্তি সমাজকর্ম প্রয়োগের যথেষ্ট ক্ষেত্র রয়েছে। যদিও সকল ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ হচ্ছে না। তবে দু’একটা ক্ষেত্রে ব্যক্তি সমাজকর্মের কিছুটা অনুশীলন লক্ষ্য করা যায়। তবে যে কথা বলা দরকার তা হলো সময়ের পরিবর্তন ঘটেছে সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনে। বিশেষ করে শিল্পবিপ্লবোত্তর
পরিবর্তনের ঢেউ এসে লেগেছে মানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রে। তাই মানুষের সমস্যার ক্ষেত্রে আজ এত বৈচিত্র্যতা। সমসাময়িক সমস্যা মোকাবিলায় কৌশল অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা যে অপরিহার্য, এ দিকটি জাতীয় নীতিনির্ধারকদের নজরে আনতে হবে। পাশাপাশি সমাজকর্ম পেশায় যারা প্রশিক্ষণ প্রদান করছেন এবং যারা প্রশিক্ষিত হচ্ছেন তাদেরকেও সমাজকর্মের উপযোগিতা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণায় অংশগ্রহণ করতে হবে। তবেই এদেশে ব্যক্তি সমাজকর্মের প্রয়োগ
নিশ্চিতকরণ সম্ভব হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।