অথবা, ইকবালের স্বজ্ঞাবাদ বা বোধ্বিাদ কি?
অথবা, ইকবালের স্বজ্ঞাবাদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও।
অথবা, ইকবালের স্বজ্ঞাবাদ সম্পর্কে যা জান সংক্ষেপে লেখ।
অথবা, সংক্ষেপে ইকবালের স্বজ্ঞাবাদ সম্পর্কে যা জান লেখ।
উত্তরা৷ ভূমিকা : মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে আল্লামা ইকবাল বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। উপমহাদেশের মুসলিম চিন্তাধারা সমৃদ্ধ করেন তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি মুসলিম দর্শনে প্রাচ্যের অধ্যাত্মবাদ এবং
পাশ্চাত্যের বস্তুবাদের সমন্বয়সাধন করেন। তিনি তাঁর জ্ঞান ও কর্মের মাধ্যমে উপমহাদেশের মুসলিম জাতিকে নবজাগরণের পথ নির্দেশ করে গেছেন। তিনি যেসব বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন স্বজ্ঞাবাদ বা বোধিবাদ তাঁর মধ্যে অন্যতম মতবাদ।
ইকবালের স্বজ্ঞাবাদ বা বোধিবাদ : ইকবালের মতে, মানবীয় জ্ঞানের আকার বা স্বরূপ দেশ ও কাল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, বরং মানসিক শক্তির হ্রাসবৃদ্ধির সাথে সাথে এগুলোর অর্থও পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ মনোবিকাশের
উচ্চতর পর্যায়ে এমন এক ধরনের বিশ্বাস করতেন যা দেশ-কালের স্বাভাবিক স্তরের ঊর্ধ্বে। এটাই স্বজ্ঞার স্তর। তাঁর স্বজ্ঞাবাদ এ স্তরকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। স্বজ্ঞা হলো এক ধরনের অতীন্দ্রিয় অনুভূতি। ইকবালের স্বজ্ঞাবাদ নিম্নে আলোচনা করা হলো।
প্রথমত, স্বজ্ঞা হলো এক ধরনের সত্তা সম্পর্কিত প্রত্যক্ষ বা সরাসরি অভিজ্ঞতা। এ ধরনের অভিজ্ঞতা বুদ্ধিপ্রসূত জ্ঞান
থেকে ভিন্নতর। এ ধরনের অভিজ্ঞতা প্রাত্যক্ষিক জ্ঞান থেকেও স্বতন্ত্র। প্রাত্যক্ষিক জ্ঞান অসম্পূর্ণ এবং এতে সংবেদনের
ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ । স্বজ্ঞাপ্রসূত অভিজ্ঞতায় ব্যক্তি বাস্তবসত্তার সমগ্রতাকে একসঙ্গে উপলব্ধি করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, স্বজ্ঞা হলো একটি বিশ্লেষণাতীত সমগ্র। এর মধ্যে বিষয় ও বিষয়ীর পার্থক্য করা যায় না। কারণ এখানে সমগ্র বাস্তবসত্তার্কে উপস্থাপিত করা হয় একটি অবিভাজ্য বিষয় হিসেবে। এ ধরনের সুখী বা মরমিবাদী অভিজ্ঞতায় জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের পার্থক্য তিরোহিত হয়। জ্ঞাতা জ্ঞেয় বস্তু বা সত্য হতে নিজেকে পৃথক করতে পারে না। মরমীবাদী সাধকের কাছে সবকিছু একাকার হয়ে যায়। তিনি নিজেকে জ্ঞেয় বস্তু হতে পৃথক করতে সমর্থ হন না। উভয়েই এক অভিন্ন অভিজ্ঞতায় পর্যবসিত হয়।
তৃতীয়ত, স্বজ্ঞা হলো হৃদয়ের একটি বাস্তবধর্মী বিশেষ গুণ। এ গুণের মাধ্যমে আমরা জ্ঞান আহরণ করতে পারি। মানব হৃদয়ে প্রকৃত সত্য উদ্ভাসিত হয় তখনই যখন স্বজ্ঞার সাথে আত্মার সংযোগ সাধন হয়। আর এ স্বজ্ঞামূলক জ্ঞান, দ্বারা আমরা বাস্তব জীবনের নানা ধরনের সমস্যার সমাধান করতে পারি।
চতুর্থত, স্বজ্ঞার মাধ্যমে এক অখণ্ড ঐক্য, এক অনন্য আত্মা স্বকীয় আত্মার বাইরেও বিধৃত, এ ধারণাকে বিরোধাত্মক মনে হলেও সুখী বা মরমিরা এ অনন্য আত্মার সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়। এ সম্পর্কে তার নিশ্চিত চৈতন্য থাকবে। মারমিীয় অভিজ্ঞতার কেবল ব্যক্তি ও বস্তুর সাধারণ প্রভেদ তিরোহিত করে।
ষষ্ঠত, স্বজ্ঞাত অভিজ্ঞতায় ক্রমিক কাল এর ধারণা বিলুপ্ত হয় এবং কাল তখন স্থায়ী স্থিতিকাল হিসেবে প্রকাশিত হয়। কারণ এতে সাধক সত্তাকে আংশিক বা বিচ্ছিন্নভাবে দেখেন না; বরং এক একক মুহূর্তের অনুভূতির মধ্যে তিনি অনন্ত কালকে একবারে দেখে থাকেন।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, স্বজ্ঞাবাদ বা বোধিবাদ সম্পর্কে ইকবাল যে যুক্তি তুলে ধরেছেন তা গুরুত্বের দাবিদার। যদি ও ইকবাল ফরাসি দার্শনিক কার্গমোর চিন্তাধারা দ্বারা অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত হয়েছেন তবু ও স্বজ্ঞা সম্পর্কীত তার ধারণা বার্গসের ধারণা থেকে কিছুটা ভিন্নতর।