অথবা, জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কে ইবনে রুশদের ধারণা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ইবনে রুশদের জ্ঞানতত্ত্ব বিস্তারিত বিশ্লেষণ কর।
অথবা, জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কে ইবনে রুশদের ধারণা বর্ণনা কর।
অথবা, জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কে ইবনে রুশদ কিরূপ ধারণা দেন আলোচনা কর।
অথবা, ইবনে রুশদের জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কে যা জান বিস্তারিত লেখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে যে কয়জন মুসলিম দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে তাদের মধ্যে ইবনে রুশদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি শৈশবেই শিক্ষার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। এরপর তিনি চিকিৎসা
বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হন। এরিস্টটলের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার হিসেবে ইবনে রুশদের নাম আজ স্মরণীয় হয়ে আছে। তাঁর জ্ঞানবিদ্যা মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
ইবনে রুশদের জীবনীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ : ইবনে রুশদের পুরো নাম আবুল ওলিদ মুহম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে রুশদ। তিনি স্পেনের কর্ডোভা নগরে ১১২৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অত্যন্ত মেধা ও তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন
ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হন। তিনি কুরআন, হাদিস, ফিকহ, জ্যোতিশাস্ত্র, গণিত, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি আরবি ভাষা ছাড়া গ্রিক ও হিব্রু ভাষাতেও পারদর্শী ছিলেন। তাঁর পাঠাভ্যাস এতই বেশি ছিল যে, সত্তর বছর বয়সেও তিনি নাকি নিয়মিত ষোল ঘণ্টা অধ্যয়ন করতেন।
ইবনে রুশদ প্রথম শ্রেণীর মুসলিম দার্শনিকদের মতো চিকিৎসা জগতে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। ‘কুল্লিয়াত ফিল
তিব্ব’ তাঁর অমর রচনাবলির অন্যতম। তিনি রোগ, রোগের লক্ষণ ও ওষুধ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ভেষজ সম্পর্কে তিনি ১৮ খানা গ্রন্থ রচনা করেন। ১১৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিভিলের এবং দুই বছর পরে কর্ডোভায় কাজীর পদে নিয়োজিত হন। ১৯৭২ সালে তিনি কর্ডোভার প্রধান বিচারপতির পদ অলংকৃত করেন। তিনি ছিলেন বহু গ্রন্থের প্রণেতা। তিনি এরিস্টটলের উপর ‘জামী’ ‘তখলিস’ এবং ‘শরই’ নামে তিনটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ইমাম আল গাজালির
‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’ গ্রন্থের জবাবে ‘তাহফাতুত তাহফাত’ নামক গ্রন্থটি রচনা করেন। তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি গ্রন্থের
নাম হলো- ‘ফালুল মাকাল ওয়া তাবীর মা বায়নাল শারীরাহ ওয়াল হিকমাহ মিন্ আল ইতিসাল’, ‘কিতাবুল ফালাসিফা’, ‘কিতাবুল কাশাফ আন্ মানাহিজ আল আদিল্লাহ ফি আফাইদ আলমিল্লাহ’, ‘কিতাবুল ফি হারাকাত আল আফ’ প্রভৃতি। তিনি ১১৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর পরলোক গমন করেন।
ইবনে রুশদের জ্ঞান তত্ত্ব : ইবনে রুশদের জ্ঞানের পরিসীমা ব্যাপক। তিনি সবসময় জ্ঞানের সাধনে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। জ্ঞানচর্চা করা ছিল তার একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তিনি এরিস্টটলের ভাষ্যকার হিসেবে জগৎ জোড়া খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি এরিস্টটলের অন্য সব ভাষ্যকার থেকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেন। তাঁর দার্শনিক চিন্তাভাবনা এমন একটা স্বকীয় ধারা সৃষ্টি করেছিলেন যা একটি বিশেষ আদর্শ হিসেবে ইউরোপসহ সারা বিশ্বে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। ইবনে রুশদ মুসলিম দর্শনের জ্ঞান তত্ত্ব আলোচনায় সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর জ্ঞান তত্ত্ব তাঁর আত্মা সম্পর্কিত দর্শনের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত। তিনি চালক বুদ্ধিবৃত্তির মতো উচ্চতর বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা করেন। তিনি আত্মা ও বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে অতি সতর্কতার সাথে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তালখিজ কিতাব আল নাফস’ গ্রন্থে জ্ঞান সম্পর্কে বলেছেন, এ গ্রন্থের উদ্দেশ্য হইল ভাষ্যকারদের সেইসব অভিমত সম্পর্কে
আলোচনা করা যাহা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সঙ্গে অধিকতর সংশ্লিষ্ট এবং এরিস্টটলের উদ্দেশ্যের সঙ্গে অধিকতর সংগত
।” সুতরাং জগতে ইবনে রুশদের প্রভাব অধিক।
“ইবনে রুশদের মতে, ইতর প্রাণীর জ্ঞানলাভের উপায় হলো সংবেদন ও কল্পনা। আর মানুষের জ্ঞানলাভের উপায় হলো সংবেদন, কল্পনা ও বুদ্ধি। বুদ্ধির মাধ্যমে সার্বিক বা বিশেষের জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। তাঁর মতে, মানবীয় জ্ঞান
বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা অর্জিত হয়। জ্ঞান শব্দটি ইতর প্রাণী, মানুষ ও আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। একমাত্র মানুষই সার্বিক জ্ঞান লাভ করতে পারে। ইতর প্রাণীর দ্বারা সার্বিক জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। তারা লাভ করতে পারে বিশেষ জ্ঞান। সুতরাং মানুষের জ্ঞান ইতর প্রাণীর জ্ঞানের অনেক উপরে। ইবনে রুশদের মতে, মানুষের জ্ঞানেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে মানুষের জ্ঞান ইতর প্রাণীর জ্ঞানের চেয়ে অধিক ব্যাপক। মানুষের কথা বলা এবং যুক্তি প্রদান করার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু ইতর প্রাণীর কথা বলা ও যুক্তি প্রদান করার ক্ষমতা নেই। মানুষ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বিশেষ বস্তুকে প্রত্যক্ষ করে। মানুষের প্রত্যক্ষণ প্রত্যক্ষীভূত বস্তুর পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হয়। তবে আল্লাহর জ্ঞান চিরন্তন এবং মানুষের জ্ঞান অস্থায়ী। ইবনে রুশদ মনে করেন, বিশেষ জ্ঞান সংবেদন ও কল্পনার ফল এবং সার্বিক জ্ঞান বুদ্ধিবৃত্তির ফল। বুদ্ধিবৃত্তির তিনটি
মৌলিক কাজ রয়েছে। যথা : পৃথকীকরণ, সংমিশ্রণ ও অবধারণ। বুদ্ধিবৃত্তির আবার দুটি দিক রয়েছে। যথা : তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক। তাত্ত্বিক বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা মানুষ সার্বিক প্রত্যয় জানতে পারে। আর ব্যবহারিক বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা মানুষ প্রয়োজনীয় শিল্পকলা সৃষ্টি করতে পারে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, ইবনে রুশদের নাম পাশ্চাত্য জগতে খুবই জনপ্রিয়। তাঁর জ্ঞান তত্ত্ব দর্শনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং কুসংস্কার ও পঙ্গুকারী প্রভাব হতে ইউরোপকে নতুন জীবন দান করেছিল। সুতরাং মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে ইবনে রুশদের জ্ঞান তত্ত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ।