অথবা, ইবনে রুশদ আল্লাহ্র গুণাবলি সম্পর্কে কী বলেন?
অথবা, আল্লাহ গুণাবলি সম্পর্কে ইবনে রুশদের মতবাদ সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, আল্লাহ গুণাবলি সম্পর্কে ইবনে রুশদ কিরূপ মতবাদ দেন?
অথবা, আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে ইবনে রুশদের মতবাদ সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে ইবনে রুশদ দার্শনিকদের মতবাদ ও গাজালির মতবাদকে সমন্বিত করার চেষ্টা করেন। দার্শনিকদের মধ্যে আল্লাহর কোন গুণ আছে কি না বা তাঁকে কোন বিশেষ গুণে গুণান্বিত করা যায় কি না তা নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। মুসলিম দর্শনের প্রাথমিক স্তরে আবির্ভূত ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের মধ্যে
প্রায় সকলেই এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। মুতাজিলা ও আশারিয়া হচ্ছে তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায়।
দার্শনিকদের যুক্তি : আল্লাহর কোন গুণ নেই এটা প্রমাণে দার্শনিকদের যুক্তি :
১. দার্শনিকদের মতে, যদি আল্লাহর গুণাবলি থাকে তাহলে আল্লাহ এবং তাঁর গুণের মধ্যে যে সম্পর্ক থাকবে তার তিনটি বিকল্প থাকতে পারে।
i. একটি অস্তিত্বের জন্য অপরটির মুখাপেক্ষী হবে না।
ii. কোনটিই কোনটির মুখাপেক্ষী হবে না।
iii. একটি মুখাপেক্ষী হলেও অন্যটি মুখাপেক্ষী হবে না।
২. মানবিক গুণাবলির সাথে দার্শনিকরা তুলনা করে দেখান যে জ্ঞান, শক্তি ইত্যাদি গুণগুলো আমাদের সত্তার প্রকৃতির সাথে নিহিত নয়, বরং এগুলো আকস্মিক। এ গুণগুলো আল্লাহর উপর আরোপ করলে আল্লাহ এ গুণ
দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বেন।
দার্শনিকদের বিরুদ্ধে ইমাম আল-গাজালির যুক্তি :
১. গাজালির মতে, দার্শনিকদের যুক্তি কিছু নঞর্থক প্রমাণ ছাড়া আর কিছুই নয়। গুণসমূহের সমস্যার সাথে আল্লাহর দ্বিত্বতা সমস্যা এক করে দেখা যায় না।
২. দার্শনিকগণ যেভাবে আল্লাহকে গুণারোপ করার মাধ্যমে তাকে অভাবী ভাবা হবে বলে মনে করেন তা সঙ্গত নয়। কারণ আল্লাহ হলো প্রথম কারণ। প্রথম কারণ সৃষ্ট নয় ফলে তাঁর কোন অভাবও নেই।
ইবনে রুশদের অভিমত : আল্লাহর গুণ সম্পর্কে ইবনে রুশদ তাঁর ‘Tahafut al Tahafut’ নামক গ্রন্থে গাজালির মতবাদ ও দার্শনিকদের মতবাদকে পর্যালোচনার মাধ্যমে একটি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে এটার ব্যাখ্যা দেন। তিনি একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লাহর গুণকে স্বীকার করে নেন। আল্লাহর গুণ সম্পর্কে ইবনে রুশদের দৃষ্টিভঙ্গি নিম্নরূপ :
১. ইবনে রুশদের মতে, সকল দার্শনিক আল্লাহর গুণাবলির বহুত্বকে অস্বীকার করেন। দার্শনিকদের ধারণা এ গুণাবলি একটি সত্তার অন্তর্ভুক্ত বিষয়। এটা একই সত্তা থেকে নিঃসৃত। জ্ঞান, শক্তি, ইচ্ছা সবই এখানে একই
রকম। শক্তি এবং শক্তিমান, জ্ঞান এবং জ্ঞাতা ইচ্ছা এবং ইচ্ছাকারী এখানে এক এবং অভিন্ন। তাঁরা আল্লাহর সত্তার অতিরিক্ত গুণাবলি স্বীকার করে গুণাবলিকে আল্লাহর সত্তার সাথে একীভূত করে ফেলেন।
২. ইবনে রুশদের ধারণার দুই ধরনের পূর্ণতা রয়েছে। যথা :
i. স্বকীয়ভাবে পূর্ণতা এবং
ii. আরোপ করে সৃষ্ট পূর্ণতা।
যদি আল্লাহর গুণ এমন হয় যে, তা স্বসৃষ্ট তবে ঐ গুণ ও আল্লাহর সত্তা এক বা একীভূত হয়ে যায়। ইবনে রুশদ বলতে চান, আল্লাহ স্বকীয়ভাবে পূর্ণ, ফলে তিনি তাঁর গুণাবলির মুখাপেক্ষী নয়। সুতরাং তাঁর গুণাবলি তাঁর সাথে দ্বৈততা সৃষ্টি করে না।
৩. ইবনে রুশদ মনে করেন কোন সমন্বয় অস্তিত্বের মত নয়। অর্থাৎ যে অর্থে সমন্বিত গুণাবলিকে চিরন্তন বলা যায়, সে অর্থে অস্তিত্বকে কোন গুণাবলি বলা সম্ভব নয়। মূলত অস্তিত্ব কোন গুণই নয়। যদি অস্তিত্বকে গুণ বলা হয়, তবে ধরে নিতে হবে এর নিজস্ব সারসত্তা রয়েছে। তবে সমন্বিত গুণাবলির মধ্যে কোন গুণাবলিকে সারসত্তা সম্পন্ন বলা চলে না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ইবনে রুশদের মূল উদ্দেশ্য হলো দার্শনিকদের মতবাদ ও গাজালির মতবাদকে সমন্বিত করার চেষ্টা করা। তাঁর ধারণা দার্শনিকগণ ও গাজাল
ি উভয়ই আল্লাহর অসীমত্বকে ও একত্বকে রক্ষা
করতে চেয়েছেন। তবে যেভাবে ইবনে রুশদ আল্লাহর গুণকে মানবিক গুণাবলি থেকে পৃথক করেছেন এবং তাঁর সত্তার অন্ত নিহিত গুণ বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুবই যুক্তিসঙ্গত। সুতরাং এক্ষেত্রে তাঁর মতবাদের গুরুত্ব অপরিসীম।