অথবা, দার্শনিকদের বিরুদ্ধে আল-গাজালির প্রধান অভিযোগসমূহ উল্লেখ কর। তাঁদেরকে কাফের বলার কারণ কী?
অথবা, দার্শনিকদের বিরুদ্ধে আল-গাজালির প্রধান অভিযোগসমূহ বর্ণনা কর। দার্শনিকদের তিনি কেন কাফের বলেছেন তা উল্লেখ কর।
অথবা, দার্শনিকদের বিরুদ্ধে আল-গাজালির প্রধান অভিযোগসমূহ উল্লেখ করে তাদের কাফের বলার কারণ বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ইমাম আল-গাজালি ছিলেন কঠোর অধ্যবসায়ী এবং অসাধারণ মেধাবী। তিনি একাধারে ধর্মতত্ত্ববিদ, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, কবি, সুফি সাধক ও সমাজসংস্কারক। তাঁর জীবনে মেধা ও সাধনা, তত্ত্ব ও অনুশীলন, বিশ্বাস ও যুক্তির এক অপূর্ব সুসমন্বয় ঘটেছিল। তাঁর মেধা ও মননের সম্পূর্ণ অংশই তিনি ব্যয় করেছিলেন সৎকাজে। ইমাম আল-গাজালি ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি কেবল উপদেশ দেন নি; বরং নিজের জীবনে তিনি তা পালনও করেছেন।
গাজালির জীবন : গাজালি ১০৫৮ সালে ইরানের খোরাসান নামক প্রদেশের অন্তর্গত তুস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম হচ্ছে আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে তাউস আহম্মদ আল-তুসী আল-শাফী আল- নিশাপুরী। গাজালি তাঁর মূল নাম নয়, উপাধি। তাঁকে গাজালি নামকরণের ক্ষেত্রে মতভেদ রয়েছে। আবু নসর ইসমাইলের
নিকট থেকে ইমাম আল-গাজালি কুরআন, হাদিস, ফিকাহ বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। ছাত্রাবস্থায়ই তাঁর বিজ্ঞতার খবর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও মেধার উর্বরতা দেখে তাঁর খ্যাতনামা শিক্ষকরাও বিস্মিত হন। ১১১১ সালের (৫০৫ হিজরি) ১৮ ডিসেম্বর তিনি এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। –
দার্শনিকদের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগসমূহ : ‘তাহাফুতুল ফালাসিফা’ গ্রন্থে ইমাম আল-গাজালি দার্শনিকদের যে সমালোচনা করেছেন, তাকে তিনি বিশটি সমস্যা আকারে আলোচনা করেছেন। তাঁর উক্ত গ্রন্থে তিনি
বিশটি বিষয়ে দার্শনিকদের মতবাদ পর্যালোচনা করেছেন। তিনি এ বিশটি সমস্যাকে আলোচনা করে দেখেছেন যে,
দার্শনিকদের মতবাদ এর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভ্রান্ত। অন্যদিকে এর মধ্যে কিছু মতবাদ রয়েছে, যা দার্শনিকদের মারাত্মক
পদস্খলন ঘটিয়েছে। ফালাসিফা সম্প্রদায়ের মুসলিম দার্শনিকদের বিরুদ্ধে তাঁর প্রধান আক্রমণ ছিল। তাঁর মনোযোগ দার্শনিকদের কিছু মতবাদের দিকে বিশেষভাবে আকর্ষিত হয়। দার্শনিকদের মতবাদের মধ্যে তিনটি মতবাদের কথা তিনি তাঁর ‘তাহাফুতুল
ফালাসিফা’ গ্রন্থের পরিশিষ্টে উল্লেখ করেন এবং তিনি নিম্নোক্ত কারণে দার্শনিকদের কাফের বলে ঘোষণা করেন। তা হলো:
১. জগতের অনাদিত্ব স্বীকার করা।
২. আল্লাহর বিশেষ জ্ঞান নেই এমন মনে করা।
৩. দৈহিক পুনরুত্থানের বিষয়টা অস্বীকার করা।ইমাম আল-গাজালির মতে, “নিম্নলিখিত তিনটি সমস্যায় তাহাদেরকে কাফির না বলিয়া উপায় নাই।” জগতের অনাদি হওয়া সমস্যা। তাদের এ বিষয়ে মত হল যাবতীয় পদার্থ অনাদি ও অবিনশ্বর। তাদের ধারণা, আল্লাহতায়ালা সৃষ্ট প্রাণী কর্তৃক কৃতকার্য বা আংশিক নিয়মগুলো অবগত নন।
গ. দৈহিক পুনরুত্থানের অস্বীকৃতি।
খ. দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইমাম আল-গাজালি তাঁদের এসব মতবাদ তাঁর তাহাফুতুল ফালাসিফা
নামক গ্রন্থের যথাক্রমে প্রথম সমস্যা, একাদশ সমস্যা ও বিংশ সমস্যা শিরোনামে আলোচনা করেন। তিনি তিনটি মতবাদ সম্পর্কে তার উক্ত গ্রন্থের পরিশিষ্টে আরও যে অভিযোগগুলো উত্থাপন করেন তার সার সংক্ষেপ নিম্নে আলোচনা করা হল ঃ
১. ইসলামের মূলনীতির সাথে বা শরিয়তের সাথে এ মতবাদসমূহ মোটেই সংগতিপূর্ণ নয়।
২. বিশ্বাসী ব্যক্তি নবী রাসূলদের এগুলো মিথ্যাবাদীর পর্যায়ে ফেলে দেয়।
৩. গাজালির ধারণা দার্শনিকদের মত করে বলা যায়, নবী রাসূলগণ হয় নিজ থেকে এগুলো অর্থাৎ উপরিউক্ত মতবাদের বিরোধতা করেছেন, নতুবা মানুষকে বুঝানোর জন্য এমনটা করেছ
েন। গাজালি মত প্রকাশ করেন, দার্শনিকদের অন্তত উপরিউক্ত তিনটি মতবাদের জন্য কাফের না বলে পারা যায় না।
গাজালিকে কাফের বলার কারণ : যেসব দার্শনিক গাজালিকে কাফের বলে ঘোষণা করেছেন তাঁদের অনেকই ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামের প্রতি যথেষ্ট দুর্বল ছিলেন। তাঁরা ইসলামের মৌলিক নীতি মেনে চলতেন ও ইবাদত বন্দেগি করতেন। তাঁরা দার্শনিক যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে হয়তো এমন মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করে বসেছেন, যা
ইসলামের মৌলিক নীতি আদর্শের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। তাঁর উল্লিখিত তিনটি বিষয় বলিষ্ঠ উদাহরণ। এক্ষেত্রে গাজালি যথার্থই মন্তব্য করেছেন। তবে যেভাবে তিনি তাঁদেরকে সরাসরি কাফের বলে ঘোষণা করেছেন সে ব্যাপারে তিনি সঠিক করেছেন কি না তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। হাদিসে আছে, “কোন মানুষ যেন কোন মানুষকে কাফের ও ফাসেক না বলে।”
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, আল-গাজালি একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে দার্শনিকদের কাফের বলেছেন। মূলত তিনি ছিলেন একজন জ্ঞানপিপাসু সাধক পুরুষ। তিনি সুনিশ্চিত সত্য আবিষ্কারের জন্য জীবনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। অসাধারণ মেধাসম্পন্ন সত্যানুরাগী এ সাধক দার্শনিকদের মতবাদসমূহ পর্যালোচনা করে দেখলেন যে, তাঁদের অনেক মতবাদই সুনিশ্চিত বলে মনে করা যায় না। ফলে তিনি দার্শনিকদের বিরুদ্ধে
অভিযোগ তোলেন এবং কাফের বলে আখ্যায়িত করেন। সুতরাং তাঁর মন্তব্যকে গুরুত্বহীন বলার অবকাশ নেই।