পারলৌকিক জীবন সম্পর্কে দার্শনিকদের অভিমতের পাশাপাশি আল গাজালির অভিমত ব্যাখ্যা কর।

অথবা, পারলৌকিক জীবন সম্পর্কে দার্শনিকদের অভিমত কী? এ সম্পর্কে আল গাজালির অভিমত আলোচনা কর।
অথবা, পরলৌকিক জীবন সম্পর্কে দার্শনিকদের অভিমতের পাশাপাশি আল-গাজালির অভিমত বিশ্লেষণ কর।
অথবা, পরলৌকিক জীবন সম্পর্কে দার্শনিকগণ কী মতবাদ দেন? এ সম্পর্কে আল- গাজালির অভিমত বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মুসলমান দার্শনিকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক ছিলেন ইমাম আল গাজালি। তিনি দার্শনিকদের দুই ধরনের জীবনের কথা বলেন- ইহলৌকিক জীবন ও পারলৌকিক জীবন। ইহলৌকিক জীবন ক্ষণস্থায়ী। আর পারলৌকিক জীবন দীর্ঘস্থায়ী। এ জীবনের কোন শেষ নেই। মুসলিম দার্শনিকগণ বিশ্বাস করেন, এ জীবন হলো পাপ- পূণ্যের হিসাব নিকাশের জীবন। মানুষের ইন্তেকালের পরের জীবন হলো পারলৌকিক জীবন। পারলৌকিক জীবন সম্পর্কে দার্শনিকরা এবং আল গাজ়ালি ব্যাপক আলোচনা করেন।
পারলৌকিক জীবন সম্পর্কে দার্শনিকদের অভিমত : দার্শনিকদের মতে, মানুষের মৃত্যুর পর যে জীবন শুরু হয় সে জীবন হলো পারলৌকিক জীবন বা আখেরাতের জীবন। তাদের মতে, পারলৌকিক জীবনই হলো প্রকৃত ও বাস্তব জীবন। এ জীবন অনন্ত ও অসীম। এ জীবনের কোন শেষ বা পরিসমাপ্তি নেই। মানুষ ইহজীবনে যে কাজকর্ম করবে,.পারলৌকিক জীবনে সে তার ফল ভোগ করবে। ভালো কাজ করলে পুরস্কৃত হবেন এবং খারাপ কাজ করলে শাস্তি ভোগ করবে। তাই আল্লাহতায়ালা যথার্থ ঘোষণা করেন, পাপ ও পুণ্যের ফল অবশ্যই ভোগ করবে। দার্শনিকরা মনে করেন, মানুষের আত্মা অমর ও অবিনশ্বর। এ আত্মা মানুষের মৃত্যুর পর শরীর বা দেহ থেকে আলাদা হয়ে যায়। পরবর্তীতে এ আত্মা আর জীবিত হয় না। আত্মা দেহ থেকে পৃথক হয়ে গেলে দেহ পচে গলে মাটির সাথে মিশে যায়।
দার্শনিকরা মনে করেন যে, মানসিক সুখ দৈহিক সুখের চেয়ে অধিকতর শ্রেয়। আল্লাহতায়ালা যেসব সুখের কথা মানুষের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেছেন তার মূলকথা হলো তিনি মানুষকে আত্মিকভাবে এগুলো অনুভব করতে বলেছেন। দৈহিকভাবে এগুলো কখনো অনুভব করার কথা বলেন নি। আল্লাহ বেহেশতের যেসব সুখের কথা ঘোষণা করেছেন তা হলো সুস্বাদু খাদ্য, পানীয় এবং অপরূপ সুন্দরী হুর ইত্যাদি। এ গুলো দৈহিক উপভোগের ইঙ্গিত বহন করে। কিন্তু দার্শনিকরা বলেন, এগুলো রূপক।
দার্শনিকদের মতে, শুধু আত্মা অমর। মানুষের জন্মের সময় আল্লাহ যেমন আত্মা ও দেহের মিলন ঘটান তেমনি শেষ বিচারের দিনেও তিনি আত্মা ও দেহের মিলন ঘটাবেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “আল্লাহ মানুষের মধ্যে তাঁর নিজস্ব সত্তা প্রতিষ্ঠা করেছেন। সূর্যের রশ্মি যেমন জগতের বিভিন্ন বস্তুর উপর প্রতিফলিত হয় এবং তাদের সজীব করে তোলে তেমনি ঐশী আলোক দেহের মধ্যে প্রবেশ করে মানুষকে একটি আত্মা প্রদান করে।” আল্লাহ বেহেশতের সুস্বাদু খাদ্য, পানীয় ইত্যাদির কথা বলেছেন। সুখের পরিমাণ বুঝানোর জন্য এগুলোর কথা বলেছেন। কারণ পৃথিবীর মানুষ পৃথিবীর শোভনীয় বিষয়ের উদাহরণ ছাড়া জান্নাতের বিষয়গুলো বুঝতে পারে না। পৃথিবীর শাস্তি যেমন অগ্নির দহন, সর্প দংশন ইত্যাদি দিয়ে উদাহরণ না দিলে মানুষ কখনো জাহান্নামের শাস্তির কথা অনুভব করতে পারবে না। ফলে দৈহিক ভোগের ব্যাপার নয়। বরং আগাম ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে মৃত্যুর পর আত্মাকে এ রকম সুখ বা দুঃখ ভোগ করতে হবে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে যে, “কোন মানুষই জানে না যে, তার জন্য তার নয়ন তৃপ্তিকর কিছু বস্তু গোপন করেছে ।” (সূরা – ৩২, আয়াত-১৭)
পবিত্র কুরআনে আরো বলা হয়েছে, “আমি আমার সৎ বান্দাদের জন্য এমন কিছু প্রস্তুত রেখেছি, যা কোন চক্ষু দেখে নাই।”.দার্শনিকদের মতে, ইহজীবনে আমরা যে সুখ বা দুঃখ ভোগ করি তার চেয়ে বেশি সুখ বা দুঃখ পারলৌকিক জীবনে। পারলৌকিক বা আখেরাতের জীবনকে দৈহিকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়, যা আত্মিকভাবে অনুভব করা যায়।
ইমাম আল গাজালির অভিমত : মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে দ ার্শনিকরা সন্দেহ প্রকাশ করেন। তারা মৃত্যুর পর দৈহিক সুখ-দুঃখ এবং বেহেশত ও দোযখের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তাদের মতে, মানুষের মৃত্যুর পর তাদের দেহ মাটির সঙ্গে মিশে যায়। আর যা মাটির সঙ্গে বিলীন হয়ে যায় তা কখনো পুনরুত্থান হয় না। কিন্তু আল.গাজালি দার্শনিকদের এসব যুক্তিকে ভ্রান্ত বলে মনে করেন। তিনি বলেন, মানুষের মৃত্যুর পর দৈহিক পুনরুত্থান বা পরকালের জীবনের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। দার্শনিকরা পারলৌকিক জীবনের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করতে গিয়ে প্লোটিনাসের দেহ-মন দ্বৈততার মতটিকে গ্রহণ করেছেন। তাদের মতে, দেহ আত্মার সমাধি ও কারগারস্বরূপ। জন্মের~- সময় দেহের সাথে আত্মার মিলন হলে মৃত্যুর পরও দেহের সাথে আত্মার মিলন ঘটবে। দেহের সাথে আত্মার মিলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রত্যেক মানুষের উচিত মৃত্যুর পর দেহ ও আত্মার পুনর্মিলনের অপেক্ষায় না থেকে এ জগতের দৈহিক কলুষতা থেকে আত্মাকে মুক্ত করার চেষ্টা করা। গাজালির মতে, আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং দয়ালু । বাইরের শক্তি দ্বারা তার ইচ্ছা কখনো সীমিত নয়। তাঁর পক্ষে
দৈহিক পুনরুত্থানের মতো কোন অলৌকিক ঘটনা ঘটানো অসম্ভব নয়। আল্লাহর ইচ্ছাই যদি সব সৃষ্টির কারণ হয়ে থাকে তাহলে তাঁর ইচ্ছায় মৃত্যুর পর দৈহিক পুনরুত্থান ঘটাও সম্ভব। দার্শনিকদের মতে, পারলৌকিক জীবন আধ্যাত্মিক। বেহেশত ও দোযখ আসলে কোন স্থান নির্দেশ করে না, বরং মনের অবস্থাকে বুঝায়। তাঁরা স্বীকার করেন যে, কুরআনের কোন কোন অংশে বেহেশত ও দোযখ তথা পারলৌকিক জীবনকে পদার্থিক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু আল গাজালির মতে, দার্শনিকদের এসব যুক্তি ভ্রান্ত। আসলে তারা কুরআনের সেসব বাণীই নির্বাচন করেছেন যেগুলো তাঁদের নিজেদের ব্যাখ্যার পক্ষে অনুকূল।.পবিত্র কুরআনে পারলৌকিক জীবনে যেসব বিষয়ের কথা বলা হয়েছে আল্লাহর পক্ষে তা করা সবসময় সম্ভব। কিন্তু
গাজালির মতে, সেগুলো শুধু ভাষাগত অর্থে গ্রহণ করা সম্ভব।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, দৈহিক পুনরুত্থান বা পারলৌকিক জীবন সম্পর্কে দার্শনিকদের অভিমতকে আল গাজালি যেভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। এমনকি তিনি দেখাতে সক্ষম হয়েছেন যে, দার্শনিকরা পারলৌকিক জীবন সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন তার মধ্যে সবগুলো শরিয়ত.বিরোধী নয়। তাছাড়া কুরআনে বর্ণিত জান্নাত ও জাহান্নাম অস্বীকার করাও শরিয়তের খেলাপ। তিনি কুরআনে বর্ণিত বিষয়গুলোকে গ্রহণ করার প্রতি জোর দিয়েছেন। সুতরাং পারলৌকিক জীবন সম্পর্কে গাজালির অভিমত মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।