জগতের সৃষ্টিকর্তা ও কারণ সম্পর্কে দার্শনিকদের যুক্তি কিভাবে ইমাম আল গাজালি খণ্ডন করেন তা ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।

অথবা, জগতের সৃষ্টিকর্তা ও কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন দার্শনিকদের মতবাদ আলোচনাপূর্বক মাম আল গাজালির যুক্তি ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
অথবা, জগতের সৃষ্টিকর্তা ও কারণ সম্পর্কে দার্শনিকদের যুক্তি কিভাবে ইমাম আল- গাজালি খণ্ডন করেন তা বিশ্লেষণ কর।
অথবা, জগতের সৃষ্টিকর্তা ও কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন দার্শনিকদের মতবাদের প্রেক্ষিতে ইমাম আল-গাজালির যুক্তি বিস্তারিত বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
একাদশ শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বে যে কয়জন মুসলিম চিন্তাবিদের আবির্ভাব ঘটে তাদের মধ্যে আল গাজালির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জ্ঞানের গভীরতায় এবং চিন্তার মৌলিকতায় বিশ্ব ইতিহাসে আল গাজালির নাম চির অবিস্মরণীয়। মুসলিম ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তাধারার ইতিহাসে তিনি অন্যতম সাক্ষর রেখেছেন। তিনি ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’ নামক গ্রন্থে জগতের সৃষ্টিকর্তা ও কারণ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
জগতের সৃষ্টিকর্তা ও কারণ সম্পর্কে দার্শনিকদের মতবাদ : ইমাম আল গাজালি জগতের সৃষ্টিকর্তা ও কারণ সম্পর্কে দার্শনিকদের আলোচনাকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা :
১. একদল দার্শনিক মনে করেন যে, জগতের কোনকিছুই স্থায়ী নয়, সবকিছুই.পরিবর্তনশীল। আর পরিবর্তনশীল
বলেই জগৎ সৃষ্ট, অনাদি নয়। আর সৃষ্টি বলেই জগতের একজন স্রষ্টা থাকা অবশ্যই প্রয়োজন ।
২. নাস্তিক ও জড়বাদী দার্শনিকদের মতে, এ জগৎ কখনো সৃষ্টি হয় নি। তাই এর কোন সৃষ্টিকর্তা ও কারণ নেই। সুতরাং জগৎ অনাদি ও অনন্ত।
৩. বর্তমান জগৎ অনাদি ও অনন্ত। এ অনন্ত জগতের একটি কারণ অবশ্যই প্রয়োজন। আর এ কারণ হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা বা আল্লাহ ।
উপর্যুক্ত তিন শ্রেণীর দার্শনিকদের আল গাজালি প্রথম শ্রেণীর দার্শনিকদের সমর্থন করেন এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর দার্শনিকদের মতবাদ খণ্ডনের চেষ্টা করেন।

  • এ সম্পর্কে নাস্তিকবাদী ও জড়বাদী
    নাস্তিক ও জড়বাদী দার্শনিকদের যুক্তি : জগতের সৃষ্টিকর্তা ও কারণ নেই দার্শনিকরা যেসব যুক্তি দেখিয়েছেন, তার মূলকথা হলো সৃষ্ট বস্তুরই কেবল সৃষ্টিকর্তা বা কারণ থাকা প্রয়োজন। জগৎ অনাদি, অনন্ত। এ অনন্ত জগতের কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। এ জগৎ সৃষ্টি হয় নি। এ জগতের শুধু আকৃতি পরিবর্তন হয়। এ জগতের চাঁদ, সূর্য সবকিছুই অনাদি ও অনন্ত। এ অনন্ত বস্তুর সবকিছুই পরিবর্তনশীল। অনাদি জগতের অস্তিত্বের পিছনে অনাদি কারণ ও সৃষ্টিকর্তা আছে, এ মতবাদে বিশ্বাসী দার্শনিকদের যুক্তি : নিম্নে এ দার্শনিকদের যুক্তিসমূহ আলোচনা করা হলো :
    ১. জগৎ অনাদি ও অনন্ত । এ অনন্ত জগতের একটি কারণ অবশ্যই থাকবে। এ অনন্ত জগতের যে কারণের কথা স্বীকার করতে হয় সেই কারণ হচ্ছে স্বয়ং আল্লাহ ।
    ২. যে সত্তা অবশ্যম্ভাবী তার কোন কারণ নেই। এ বিশ্বভ্রহ্মাণ্ড অবশম্ভাবী নয়। এর অবশ্যই কারণ দরকার। আর এ কারণ হচ্ছে আমাদের পরম করুণাময় আল্লাহ ।
    ৩.দার্শনিকরা অভিমত ব্যক্ত করেন যে, জগতের বস্তুসমূহ হয় সম্ভব সত্তা হবে নতুবা অবশ্যম্ভাবী হবে। জগতের অবশ্যই একটা কারণ থাকবে এবং সে কারণই হচ্ছে আল্লাহ।
    ৪. পৃথিবীতে প্রত্যেকটি ঘটনারই কারণ আছে। আর প্রত্যেকটি ঘটনা দ্বারাই সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে। আর এ বিশ্বের সবকিছু সৃষ্টির পিছনে একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন। তিনি হলেন আল্লাহ।
    দার্শনিকদের যুক্তি খণ্ডনে আল গাজালির যুক্তি : যেসব দার্শনিকরা আল্লাহ্কে বিশ্বাস করেন না সেসব দার্শনিক এবং বস্তুবাদী দার্শনিকদের বিরুদ্ধে আল গাজালি বলেন যে, যারা বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও কারণকে অস্বীকার করেন তারা কারণপরম্পরায় বিশ্বাস করেন। তারা সবকিছুর পিছনে বস্তুকেই স্বীকার করেন। যার কোন কারণ নেই। যারা আস্তিক তারা জগতের সৃষ্টিকর্তা বা পরম করুণাময় আল্লাহকে বিশ্বাস করেন। যারা জগতের অনাদিত্বে বিশ্বাস করেন আল গাজালি তাদের যুক্তি খণ্ডন করার চেষ্টা করেন। আল গাজালি দার্শনিকদের বিরুদ্ধে যেসব যুক্তি দেন তা নিয়ে
    আলোচনা করা হলো :
    ১. জড় বা বস্তুসমূহ সৃষ্টি হওয়া যারা বিশ্বাস করে না, তাদের পক্ষে পরম করুণাময় আল্লাহকে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।
    ২.অনাদি ও অনন্ত যা কিছুই থাকুক না কেন তার কোন কারণ থাকতে পারে না। সুতরাং জগৎ অনাদি ও অনন্ত এর কোন কারণ নেই।
    ৩.দার্শনিকদের সম্ভব ও অবশ্যম্ভাবী কথা দুটিকে গাজালি স্বীকার করেন নি। গাজালি এ শব্দ দুটিকে দার্শনিকদের ধোঁকাবাজি বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, দার্শনিকরা কখনো প্রমাণ করতে পারেন নি যে, জগৎ
    অবশ্যম্ভাবী।
    ৪. গাজালি দেখাতে চান যে, বিশেষ বিশেষ অংশ বা ঘটনা দ্বারা সমগ্র গঠিত হয়। এ সমগ্রের পিছনে কোনকিছু দেখা যায় না।
    মূল্যায়ন : যারা ধর্মীয় ও যৌক্তিক নীতি ভঙ্গ করে তারাই জগতের সৃষ্টিকর্তা ও কারণকে অবিশ্বাস করে। জগতের সৃষ্টিকর্তা ও কারণকে স্বীকার করা সকলের কর্তব্য। সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কোনকিছু সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
    উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, জগতের সৃষ্টিকর্তা ও কারণ সম্পর্কে আল গাজালি যে যুক্তি দিয়েছেন, তা মুসলিম দর্শনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে, নাস্তিক ছাড়া কেউই জগতের সৃষ্টিকর্তা ও কারণকে অস্বীকার করতে পারে না। সুতরাং এ জগতের সৃষ্টিকর্তা ও বিধানকর্তা একমাত্র আল্লাহ ।