অথবা, আত্মার কার্যাবলি সম্পর্কে আল ফারাবির মতবাদ আলোচনা কর।
অথবা, আত্মার কার্যাবলি সম্পর্কে আল ফারাবি কী বলেন?
অথবা, আত্মার কার্যাবলি সম্পর্কে আল ফারাবির মতবাদ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, আল ফারাবির দর্শনে আত্মার কার্যাবলি বর্ণনা কর।
উত্তর৷৷ ভূমিকা : পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ যে যুগকে অন্ধকারের যুগ বলে চিহ্নিত করেন, সেই অন্ধকারের যুগে জ্ঞানের মশাল নিয়ে যে কয়জন মুসলিম মনীষীর আবির্ভাব ঘটে তাদের মধ্যে আল-ফারাবির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন গ্রিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত শ্রেষ্ঠ মুসলিম চিন্তাবিদ। তাঁর দর্শনে আত্মাতত্ত্ব বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। তাই
তাঁর দর্শনে আত্মাতত্ত্বের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।
আত্মার কার্যাবলি : শরীরের প্রাণকেন্দ্র হল আত্মা। আত্মা শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরিচালনা করে। আত্মার অবনতি হলে শরীরেরও পরিবর্তন ঘটে। আত্মা শরীরের একটি প্রধান অঙ্গ। সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রাণকেন্দ্র হল আত্মা। আত্মার অধীন হল মস্তিষ্ক। শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে মস্তিষ্ক পরিচালনা করে। তবে আত্মা দ্বারা মস্তিষ্ক পরিচাালিত ও প্রশমিত। ফলে আত্মা বা কালবকে শরীরের প্রধান পরিচালক বলা যেতে পারে। আল-ফারাবি মনে করেন আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় মস্তিষ্কই শরীরের পরিচালক এবং শরীরের প্রধান অঙ্গ। বুদ্ধিবৃত্তির সাথে ফারাবি আত্মার মূল সম্পর্কের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ফারাবির আত্মা সম্পর্কে ধারণা একটি হাদিসের সাথে মিলে যায়। কালব বা আত্মা বলে মানুষের দেহের মধ্যে এমন একটি বস্তু আছে; যখন সেটা ভালো অবস্থায় থাকে তখন শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ থাকে, আর যখন সেটা নষ্ট হয় তখন সম্পূর্ণ শরীরই রোগাক্রান্ত হয়।
আত্মার বৃত্তিসমূহ : আত্মার বৃত্তিসমূহকে আল-ফারাবি পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা :
১. পৌষ্টিক বৃত্তি (Nutrative faculty),
২. সংবেদন বৃত্তি (Sensative faculty),
৩. কল্পনা বৃত্তি (Imaginative faculty),
- কামনা বৃত্তি (Appetitive faculty) এবং
৫. বুদ্ধিবৃত্তি (Rational faculty)।
১. পৌষ্টিক বৃত্তি (Nutrative faculty) : মানুষের সৃষ্টি দেহ ও মনের সমন্বয়ে। দেহের জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। পৌষ্টিক বৃত্তি বলতে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য গ্রহণ, পরিপাক ক্রিয়া ও রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় দেহের বৃদ্ধি ও শক্তি সংস্কারের ধারাকে বুঝায় । পৌষ্টিক বৃত্তি প্রধান এবং তার অনুগামী ও সহকারী বৃত্তি অনেক। যেমন- পাকস্থলি, কলিজা, প্লীহা, কিডনি ইত্যাদি।
২. সংবেদন বৃত্তি (Sensative faculty) : চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বকের মাধ্যমে আমাদের চতুষ্পার্শ্বস্থ বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য যে বৃত্তি সাহায্য করে তাকে সংবেদন বৃত্তি বলে। কোন বস্তু নরম বা কঠিন, কোনটি গরম বা ঠাণ্ডা, কোনটি মিষ্টি বা তিতা সেটা আমরা এ বৃত্তির সাহায্যে পরখ করতে পারি। শ্রবণ, দর্শন, স্বাদ, গন্ধ স্পর্শের মধ্যেই সংবেদন
বৃত্তি সীমাবদ্ধ । কোনকিছুর ভালোমন্দ এ বৃত্তির সাহায্যে যাচাই করা সম্ভব নয়।
৩. কামনা বৃত্তি (Appetitive faculty) : মানুষ যে বৃত্তির সাহায্যে কোন বস্তুকে পছন্দ বা অপছন্দ করে তাকে.কামনা বৃত্তি বলে । মানুষের মধ্যে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের তাড়নায় বিভিন্ন ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তার সহজাত স্বভাব হল.বস্তুর প্রতি আকর্ষণ ও বিকর্ষণ। চাওয়া পাওয়া পছন্দ মানবজীবনে নিত্যনৈমিত্তিক লীলাখেলা। কামনা বৃত্তির অন্তর্গত হল প্রেম, বিরহ, শান্তি, ভীতি, সুখ, দুঃখ প্রভৃতি। কামনা বৃত্তিতেও প্রধান ও সহকারী বৃত্তির অবকাশ রয়েছে। এ বৃত্তিমূলে
রয়েছে অন্তঃকরণ।
৪. কল্পনা বৃত্তি (Imaginative faculty) : পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে মানুষ যে জ্ঞান লাভ করে তা সীমিত শক্তির দরুন সার্বক্ষণিকভাবে মনে রাখতে পারে না। নতুনের আগমনে পুরাতনকে ভুলে যায়। আবার স্মৃতির কোঠায় কালের তলে বিস্মৃত বিষয়বস্তু ভেসে উঠে। কল্পনা বৃত্তি হল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোন বস্তুকে ভুলে যাওয়ার পরে পুনরায় স্মরণ করার শক্তি। এ কল্পনার উদয় হতে পারে জাগ্রত অবস্থায় অথবা ঘুমের ঘোরে। কল্পনা বৃত্তিতে পূর্বে জানা বিষয়বস্তুর সংযোজন ও বিয়োজন ঘটে। এর মধ্যে কিছু সত্য, কিছু মিথ্যা। এখানে আসল, নকল, বাস্তব অভিনয়ের লীলাভূমি। পছন্দ অপছন্দ, সুখ দুঃখ, প্রেমপ্রীতি, আকর্ষণ বিকর্ষণ, শান্তি অশান্তির ধারা কল্পনা বৃত্তিতেও পরিলক্ষিত হয়। তবে আধ্যাত্মিক চেতনা এবং নৈতিক
মূল্যবোধ প্রভৃতি বিষয়বস্তু এ বৃত্তির আওতার বাইরে। অন্তঃকরণে কল্পনা বৃত্তি অবস্থিত। এ বৃত্তির তাবেদার বা অনুগত অন্য কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই । স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের ভাস্বর হল এ বৃত্তি।
৫. বুদ্ধিবৃত্তি (Rational faculty) : মানুষ বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে চিন্তা করে। এর সাহায্যে বিজ্ঞান, শিল্পকলা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে । সৎ-অসৎ, ভালোমন্দের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে। বুদ্ধিবৃত্তি দু’প্রকার। যথা :
ক. তাত্ত্বিক ও
খ.ব্যবহারিক।
ক. তাত্ত্বিক বুদ্ধিবৃত্তি : তাত্ত্বিক বুদ্ধিবৃত্তি সম্পূর্ণভাবে চিন্তামূলক।
খ. ব্যবহারিক বুদ্ধিবৃত্তি : ব্যবহারিক বুদ্ধি চিন্তামূলক। আবার কিছুটা অনুশীলনের উপর নির্ভরশীল। বুদ্ধিবৃত্তি অন্যান্য বৃত্তিকে পরিচালিত করে এবং তাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে।
বিশ্ব পরিক্রমায় আত্মার অবস্থান : আদি বুদ্ধি হল প্রথম আদি সত্তা থেকে প্রথম বিকীর্ণ সত্তা। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম বুদ্ধি আদি বুদ্ধির পরে নির্গমনের সূত্র ধরে অস্তিত্ব লাভ করেছে। দূরবর্তী নভোমণ্ডল, স্থির নক্ষত্রমণ্ডল, শনি, বৃহস্পতি, মঙ্গল গ্রহ, সূর্য, শুক্র, বুধ ও চন্দ্র সৃষ্টি হয় ধারাবাহিকভাবে দ্বিতীয় বুদ্ধি থেকে
দশম বুদ্ধি পর্যন্ত। দশম বুদ্ধির স্তর থেকে অতিজাগতিক বুদ্ধিতে স্রষ্টার প্রক্রিয়া শেষ হয়। সক্রিয় বুদ্ধি একাদশ স্তরে সর্বপ্রথম আত্মিক জগতে সৃষ্টি হয় আত্মা,তারপর জীব, উদ্ভিদ, জড় ও চ ার উপাদান। আত্মার অবদান আধ্যাত্মিক ও পার্থিব জগতের স্তরের মাঝামাঝি।
মূল্যায়ন : আল-ফারাবি একজন বুদ্ধিবাদী মুসলিম চিন্তাবিদ। তিনি বিশ্বব্যাপী কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন। কারণ তিনি মনে করেন মানুষের আত্মিক উন্নতির সহায়ক হল কল্যাণকামী রাষ্ট্র। কিন্তু আল-ফারাবির আত্মা সম্পর্কীয় দর্শনে আত্মার অমরত্ব স্বীকার করা হলেও মানবাত্মার ব্যক্তিগত অমরতার স্থান নেই। প্রকৃতপক্ষে আল-ফারাবি.এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মা সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। মৃত্যুর পর আত্মার অবস্থান সম্পর্কে বর্ণনা প্রসঙ্গে ফারাবি বলেছেন যে, মানুষের মৃত্যুর পর তাদের আত্মা এক এক করে একত্রিত হতে থাকবে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আল-ফারাবি ছিলেন মুসলিম দর্শনের পিরামিডস্বরূপ। আত্মা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি কুরআনের সুরে সুর লিয়েছেন। মূলত তিনি ছিলেন মানবদরদি ও কল্যাণকামী। আর এ কারণেই তিনি মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য সংঘবদ্ধভাবে প্রচেষ্টার উপর জোর দিয়েছেন ও বিশ্বব্যাপী কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেছেন। সুতরাং মুসলিম দর্শনে আত্মার কার্যাবলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।