অথবা, আত্মা সম্পর্কে আল-ফারাবির মতামত বিশ্লেষণ কর।
অথবা, আল-ফারাবির আত্মাতত্ত্ব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, আত্মা-সম্পর্কে আল-ফারাবি কী মতবাদ দেন বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : প্রাচীন ও আধুনিক যুগের পাশ্চাত্য দার্শনিকেরা আত্মার প্রকৃতি, আত্মার অমরত্ব প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আল-ফারাবির দর্শনআত্মাতত্ত্ব বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি দর্শনকে দেখেছেন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির দৃষ্টিতে এবং ধর্মকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন যুক্তিবাদী দার্শনিকের অবস্থান থেকে। ফারাবি তাঁর অধিবিদ্যায় আল্লাহতত্ত্ব,
বিশ্বতত্ত্ব ও জ্ঞানতত্ত্বের সাথে আত্মাতত্ত্ব সম্পর্কেও বর্ণনা করেছেন।
আত্মার প্রকৃতি : মানুষের আত্মা মৌলিক, অবিভাজ্য এবং অতীন্দ্রিয় সত্তা। জড় থেকে এটা ভিন্ন। বুদ্ধি আত্মার সাহায্যে জড়পদার্থ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ইচ্ছার স্বাধীনতা সৃষ্টি করতে সক্ষম। আত্মা হল মৌলিক সত্তা। এর অবস্থান আলামে আমর এ; এটা নিরাকার; গতি ও স্থিতিতে তার কোন পরিবর্তন সাধিত হয় না। আলামুল মালাকুত এ আত্মা খোদার গুণগান করে। আত্মার প্রতিশব্দ হিসেবে ফারাবি কুরআনের মত বিভিন্ন স্থানে কালব, নাফস ও রুহ ব্যবহার করেছেন। মানুষের সৃষ্টি হচ্ছে দেহ ও কালের সমন্বয়ে। দেহ দেশকালের দ্বারা সীমায়িত। আত্মা এসব দৈহিক গুণাবলি থেকে মুক্ত।
আত্মার কার্যাবলি : আত্মা শরীরের প্রাণকেন্দ্র। আত্মা শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরিচালিত করে। আত্মার অবনতি যখন ঘটে, তখন শরীরেরও অবনতি ঘটে। শরীরের একটি প্রধান অঙ্গ হল আত্মা। মস্তিষ্কও আত্মার অধীন। আল- ফারাবি মনে করেন, আপাতদৃষ্টিতে মস্তিষ্ককে শরীরের পরিচালক এবং শরীরের প্রধান অঙ্গ মনে হয়। ফারাবি বুদ্ধিবৃত্তির সাথে আত্মার মূল সম্পর্কের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাঁর আত্মা সম্পর্কে ধারণা একটি হাদিসের সাথে মিলে যায়। মানুষের দেহের মধ্যে কালব বা আত্মা বলে এমন একটি বস্তু আছে, যখন সেটা ভালো অবস্থায় থাকে তখন শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ থাকে, আর যখন সেটা নষ্ট হয়, তখন সম্পূর্ণ শরীরই রোগক্রান্ত হয়।
আত্মার বৃত্তিসমূহ : আল-ফারাবির মতে, আত্মার বৃত্তি পাঁচটি। যথা :
১. পৌষ্টিক বৃত্তি (Nurative faculty),
২. সংবেদন বৃত্তি (Sensative faculty),
৩. বুদ্ধিবৃত্তি (Rational faculty),
- কল্পনা বৃত্তি (Imaginative faculty) এবং
৫. কামনা বৃত্তি (Appetitive faculty)।
১. পৌষ্টিক বৃত্তি (Nurative faculty) : মানুষের সৃষ্টি হচ্ছে দেহ ও মনের সমন্বয়ে। দেহের জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। পৌষ্টিক বৃত্তি অনেক এবং তার অনুগামী ও সহকারী বৃত্তি অনেক। যেমন- পাকস্থলি, কলিজা, প্লীহা, কিডনি ইত্যাদি।
২. সংবেদন বৃত্তি (Sensative faculty) : চোখ, নাক, কান, জিহ্বা ও ত্বকের মাধ্যমে আমাদের চতুষ্পার্শ্বস্থ বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য যে বৃত্তি সাহায্য করে তাকে সংবেদন বৃত্তি বলে। সংবেদন বৃত্তিতে অন্তঃকরণের ভূমিকাই প্রধান আর পঞ্চ ইন্দ্রিয় হল তার সহকারী।
৩. বুদ্ধিবৃত্তি (Rational faculty) : মানুষ বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে চিন্তা করে। বৃদ্ধিবৃত্তি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। যথা :
ক. তাত্ত্বিক বুদ্ধিবৃত্তি এবং
খ. ব্যবহারিক বুদ্ধিবৃত্তি।
ক. তাত্ত্বিক বুদ্ধিবৃত্তি : তাত্ত্বিক দিক সম্পূর্ণভাবে চিন্তামূলক।
খ. ব্যবহারিক বুদ্ধিবৃত্তি : ব্যবহারিক বুদ্ধিবৃত্তি কিছুটা চিন্তামূলক ও কিছুটা অনুশীলনের উপর নির্ভরশীল।
৪. কল্পনা বৃত্তি (Imaginative faculty) : কল্পনা বৃত্তি বলতে বুঝায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোন বস্তুকে ভুলে যাওয়ার পরে পুনরায় স্মরণ করার শক্তিকে। এ কল্পনার উদয় জাগ্রত অবস্থায় অথবা ঘুমের ঘোরে হতে পারে।
৫. কামনা বৃত্তি : মানুষ যে বৃত্তির সাহায্যে কোন বস্তুকে পছন্দ বা অপছন্দ করে তাকে কামনা বৃত্তি বলে। প্রেম বিরহ, শান্তি ভীতি, সুখ দুঃখ প্রভৃতি কামনা বৃত্তির অন্তর্গত।
আত্মার অমরত্বের প্রমাণ : আল-ফারাবির আত্মার অমরত্বের প্রমাণগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. আত্মা মৌলিক পদার্থ, সুতরাং আত্মা অমর।
২. মানবজীবনের লক্ষ্য হল পরকালের সুখ লাভ। আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস না করলে সুখ দুঃখ অর্থহীন হয়ে পড়ে।
৩. বৌদ্ধিক সদ্গুণ ও নৈতিক সদ্গুণের সাথেও আত্মার সম্পর্ক। মানুষের আত্মা নৈতিক ও বৌদ্ধিক সদ্গুণের উৎকর্ষের মাধ্যমে খোদার তরফ থেকে অতীন্দ্রিয় শক্তি লাভ করে। অতীন্দ্রিয় সত্তার সাথে যে আত্মার সংযোগ
যত বেশি সে আত্মা তত বেশি সুখ লাভ করবে। মানুষের জন্য যা কিছু ইহজগতে কল্যাণ ও পরজীবনে শান্তি বয়ে নিয়ে আসে তাই মহৎ। মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য সংঘবদ্ধভাবে প্রচেষ্টার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফারাবি স্বপ্ন দেখেছেন বিশ্বব্যাপী কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। তিনি রিসালা ফি আল তানবিহ, আল সাবিল আল সা’আদাহ গ্রন্থের সূচনাতে মানুষের যে শান্তির কথা উল্লেখ করেছেন সেখানে ব্যক্তিগত আত্মিক শান্তির কথাই স্পষ্টভাবে বলেছেন। ফারাবির মতে, মানুষের মৃত্যুর পর তাদের আত্মা এক এক করে একত্রিত হতে থাকবে। পবিত্র আত্মার সমাবেশ বেশি হলে আত্মার আনন্দের পরিমাণও বেশি হবে। তাঁর বক্তব্য কুরআনের সে বাণী স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে আল্লাহ আত্মাদেরকে সম্বোধন করে বলেছেন, “হে প্রশান্ত আত্মা, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের দিকে প্রত্যাবর্তন কর, তোমরা আমার আনুগত্য স্বীকার কর, ইবাদতে মগ্ন হও এবং জান্নাতে প্রবেশ কর।”
মূল্যায়ন : আল-ফারাবি মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম। আল-ফারাবি বিশ্বব্যাপী কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন। মানুষের আত্মিক উন্নতির সহায়ক হল কল্যাণকামী রাষ্ট্র। আল-ফারাবি আত্মার অমরত্বে ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করতেন কি না এ প্রসঙ্গে রবার্ট হামুল্ড পাঠকদের সংশয়ের আবর্তে ফেলেছেন। মূলত আল-ফারাবি এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মা সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। মৃত্যুর পর আত্মার অবস্থান সম্পর্কে বর্ণনা প্রসঙ্গে ফারাবি বলেছেন যে, মানুষের মৃত্যুর পর তাদের আত্মা এক এক করে একত্রিত হতে থাকবে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আল-ফারাবি আত্মা সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করতে সক্ষম হয়েছেন। পবিত্র কুরআনের সুরে সুর মিলিয়ে তিনি আত্মা সম্পর্কে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তা মু সলিম দর্শনের ইতিহাসে, খুবই অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন মানবদরদি ও কল্যাণকামী। আর এ কারণেই তিনি মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য সংঘবদ্ধভাবে প্রচেষ্টার উপর জোর দিয়েছেন ও বিশ্বব্যাপী কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেছেন।