অথবা, মুসলিম দর্শনের সম্ভাব্যতার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ লিখ।
অথবা, মুসলিম দর্শনের সম্ভাব্যতার বিরুদ্ধে উত্থাপিত আপত্তিগুলো কী কী?
উত্তর৷ ভূমিকা : মুসলিম দর্শনের মূলভিত্তি হলো কুরআন ও হাদিস। মুসলিম দর্শন হলো মুসলিম জাতির চিন্তা ও চেতনার ধারা। এ দর্শন সামগ্রিকভাবে মুসলিম জগৎ ও জীবনকে ব্যাখ্যা করে। মুসলিম দর্শন বলতে আমরা জীবন ও মূল্যবোধ বিষয়ক এমন একটি আদর্শকে বুঝবো, যা কুরআন ও হাদিসে উত্থাপিত এবং যা মুসলিম জাতির ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সে আদর্শ থেকে বিকশিত।
মুসলিম দর্শনের সম্ভাব্যতার বিরুদ্ধে আপত্তিগুলো : পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ মুসলিম দর্শনের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেছেন। তারা মুসলিম দর্শনের সম্ভাব্যতাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। তাদের মতে মুসলিম দর্শন বলে কিছু নেই। মুসলিম দর্শনের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো নিম্নরূপ :
১. ইসলাম ধর্ম বলপ্রয়োগে প্রচারিত : ইসলাম ধর্ম পেশীশক্তি দ্বারা বা বলপ্রয়োগের দ্বারা প্রচারিত হয়েছিল বলে পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ যে অভিযোগ আনয়ন করেন তার পশ্চাতে ঐতিহাসিক কোন ভিত্তি পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ দাঁড় করাতে পারে নি। ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “ধর্মে কোন জবরদস্তি নেই, সত্য ভ্রান্তির পথ থেকে আপন দীপ্তিতে দীপ্তমান।”
২. মুসলমানদের অনুধ্যানিক চিন্তার অভাব : মুসলমানদের অনুধ্যানিক চিন্তার অভাব- এ অভিযোগের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পৃথিবীর যেসব জাতির স্বর্ণময় কীর্তি সম্পর্কে ইসলাম সাক্ষ্য দেয় মুসলমান জাতি তাদের মধ্যে অন্যতম। আধুনিক মানুষের মনকে আলোড়িত করে এমন কোন প্রশ্ন নেই যা আরবরা দার্শনিকের দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেন নি। মুসলমানদের সাহিত্য, শিল্পকলা, চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও যুক্তিবিদ্যা পাশ্চাত্য জগতে তার অজ্ঞানতার অন্ধকার হতে রক্ষা করতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে।
৩. কুরআন ও ইসলামের স্বাধীন চিন্তার অবকাশ নেই : কুরআন ধর্মবিশ্বাসে তার অনুসারীদের নিকট থেকে অন্ধ অনুকরণ ও আনুগত্য দাবি করে। সুতরাং এখানে স্বাধীন চিন্তার অবকাশ নেই— পাশ্চাত্য দার্শনিকদের এ অভিযোগে পবিত্র কুরআন ও কুরআনীয় শিক্ষা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতারই পরিচয় বহন করে। একজন ইউরোপীয় মনীষী উল্লেখ করেন, কুরআনের মহান গুরুত্ব এখানে যে, কুরআন ও হাদিসের পঠন পাঠনে এটা যতটুকু গুরুত্ব প্রদান করেছে, অন্যান্য বিজ্ঞানের বেলায়ও ততটুকু গুরুত্বারোপ করেছে।”
৪. আরবগণ যুদ্ধ ও কলহপ্রিয়: আরবগণ যুদ্ধ ও কলহপ্রিয় জাতি। সুতরাং তাদের মধ্যে দার্শনিক সুলভ মন মানসিকতা নেই- পাশ্চাত্য দার্শনিকদের এরূপ অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাব যে, সূক্ষ্ম চিন্তা তত্ত্বে জিজ্ঞাসা এবং সৃজনশক্তির ক্ষেত্রে আরব জাতির গৌরব আজও অক্ষুণ্ণ আছে। জ্ঞানবিজ্ঞানের অগ্রগতির স্রোত মধ্যযুগে যখন পতনোন্মুখ তখন মুসলিম মনীষী ও চিন্তাবিদই সে স্রোতধারাকে অব্যাহত রাখেন।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি, মুসলিম চিন্তাবিদগণ কুরআন ও হাদিসকে ভিত্তি করে জীবন- জিজ্ঞাসার যে বিশদ আলোচনা ও পর্যালোচনা করেছেন তাই মুসলিম দর্শন রূপ লাভ করেছে। তাই মুসলিম দর্শনকে ইউরোপীয় দর্শনের সাথে একাত্ম করে দেখা ঠিক হবে না। কারণ মুসলিম দর্শন কেবল মুসলিম দর্শনের ন্যায়ই এবং অন্য কিছু নয়। মুসলিম দর্শন বলতে কোন দর্শন নেই, এর কোন সম্ভাবনা নেই একথা কোনভাবেই বলা যায় না। মুসলিম দর্শন বলতে অবশ্য একটা দৰ্শন আছে যা স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্যে মহীয়ান ও ভাস্বর।