শঙ্করাচার্যের মতে আত্মার মুক্তি কত প্রকার ও কী কী?

অথবা, শঙ্করের মতে আত্মার মুক্তি সম্পর্কে লিখ।
অথবা, শঙ্করের মতে আত্মার মুক্তির প্রকারভেদ লেখ।
অথবা, শঙ্করের মতে আত্মার শ্রেণিকরণ দেখাও।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মহর্ষি বাদরায়ন (আনু. ৫০০ খ্রি. পূ.) প্রণীত বেদান্তসূত্রে (৫৫৫টি সূত্র) ব্রহ্মতত্ত্ব৷ হয়েছে বলে একে ব্রহ্মসূত্র বলে। আবার জীবের স্বরূপ বর্ণিত হওয়ায় একে শারীরিকসূত্রও বলা হয়। ব্রহ্মসূত্রের সাতটি
ভাষ্যের (শঙ্করের শঙ্কভাষ্য, রামানুজের শ্রীভাষ্য, বল্লভের অনুভাষ্য, মাধ্বের পূর্ণপ্রজ্ঞাভাষ্য, নিম্বার্কের বেদান্ত পারিজাতসৌরভ, ভাস্করের ব্রহ্মসূত্রভাষ্য এবং বলদেবের গোবিন্দভাষ্য) মধ্যে শঙ্করের শঙ্করভাষ্য এবং রামানুজের শ্রীভাষ্য অন্যতম। শঙ্করাচার্য ও রামানুজ উভয়ে বাদরায়নকে অনুসরণ করে অদ্বৈতবাদ প্রচার করলেও শঙ্কারাচার্যের অদ্বৈতবাদ কেবলাদ্বৈতবাদ এবং রামানুজের অদ্বৈতবাদ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ নামে পরিচিত। শঙ্করাচার্য ও রামানুজ উভয়েই আত্মা, বন্ধন ও মোক্ষ সম্পর্কে তাদের দার্শনিক মতবাদ ব্যক্ত করেছেন।
শঙ্করের মতে আত্মার মুক্তি : শঙ্কর বলেছেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় মানুষ দেহ ও আত্মার সমষ্টি। কিন্তু আসলে তা নয়। মানুষের দেহ অন্যান্য জড় বস্তুর ন্যায় মিথ্যা অবভাস মাত্র। কেবল আত্মাই সৎ বস্তু, দেহ সৎ বস্তু নয়। এ আত্মাই ব্রহ্ম। শঙ্করের মতে, আত্মার মুক্তি দুই রকমের। যথা : ১. জীবনমুক্তি ও ২. বিদেহশক্তি। দেহযুক্ত আত্মার মুক্তিই হলো
‘জীবন্মুক্তি’ শঙ্করের ন্যায় বৌদ্ধ, জৈন, সাংখ্য প্রভৃতি দর্শনও জীবন্মুক্তির সম্ভাব্যতা স্বীকার করে। জীবন্মুক্ত ব্যক্তির সঞ্চিত কর্মফল নষ্ট হয় এবং সঞ্চীয়মানকর্ম নিষ্কাম বলে কোন ফল প্রসব করে না; তাই প্রাবদ্ধ কর্মফল ভোগ শেষ হলে জীবন্মুক্ত ব্যক্তির স্থূলদেহ নষ্ট হয়। ফলে তার বিদেহ মুক্তি ঘটে। দেহহীন আত্মার মুক্তিকে বিদেহ মুক্তি বলা হয়।
মুক্তির সাথে নিষ্কাম কর্মের বিরোধ নেই : শঙ্করের মতে, মুক্তির সাথে নিষ্কাম কর্মের কোন বিরোধ নেই। মুক্ত ব্যক্তি যদি নিষ্কাম কর্ম সম্পাদন করে। তবে তার বন্ধন হয় না। যেহেতু কেবল সকাম কর্মই বন্ধনের হেতু। যাঁরা মুক্তি লাভ করে নি তাঁরা যদি নিষ্কাম কর্ম সম্পাদন করেন তবে তাদের আত্মশুদ্ধি হয় এবং অহংকার ও স্বার্থ বুদ্ধি বিনষ্ট হয়। আর যাঁরা
মুক্তিলাভ করেছেন তাঁরা যদি নিষ্কাম কর্ম করেন, তবে সে কর্ম বন্ধ জীবগণের উপকার সাধন করে। বন্ধ জীবগণ মুক্ত ব্যক্তির নিষ্কাম ধর্মকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে মুক্তির পথে অগ্রসর হতে পারে। এ নিষ্কাম কর্ম অমুক্ত ব্যক্তিদের মুক্তিলাভে সাহায্য করে। শঙ্করের মতে, আত্মা যখন মুক্ত হয় তখন আত্মা নতুন কিছু লাভ করে না। কারণ আত্মা এবং ব্রহ্মের
একত্ববোধই মুক্তি। আর আত্মা এবং ব্রহ্ম যে এক তা চিরসত্য। আত্মা ও ব্রহ্মের একত্বের উপলব্ধিই মুক্তি। অনেক সমালোচকদের দৃষ্টিতে পাপপুণ্য। ন্যায় অন্যায় প্রভৃতির ভেদ বেদান্তে স্বীকৃত হয় নি। তাই অদ্বৈত মতবাদ সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর। শঙ্কর এ ভেদকে মিথ্যা বলে নি। তবে পারমার্থিক দৃষ্টিতে শঙ্কর এ ভেদের অস্তিত্ব স্বীকার করেন নি।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বেদান্ত দর্শনে রামানুজ ও শঙ্কর উভয়েরই মতবাদ সমান গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছেন। কিন্তু বিষয়ে তাদের মতে পার্থক্য থাকলেও তাদের গতি ও লক্ষ্য এক। তাই বেদান্ত দর্শনে উভয়কেই প্রয়োজন রয়েছে।