অথবা, শঙ্কর ব্রহ্মকে নির্গুণ মনে করেন কেন?
অথবা, শঙ্করের মতে ব্রহ্ম কোন অর্থে নির্গুণ?
অথবা, ব্রহ্মকে শঙ্কর কোন অর্থে নির্গুণ বলে অভিহিত করেন?
উত্তর৷৷ ভূমিকা : অষ্টাদশ শতকে দক্ষিণ ভারতের কেরল প্রদেশের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে শঙ্করের জন্ম হয় । শঙ্কর অসাধারণ ধীশক্তি, সূক্ষ্মবিচারবোধ, গভীর আধ্যাত্মবোধ, অসাধারণ কর্মক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তিনি তাঁর স্বল্প জীবদ্দশায় যে দার্শনিক প্রতিভার পরিচয় দেন তা দর্শনের ইতিহাসে বিরল। শঙ্করের রচিত অনেক গ্রন্থ রয়েছে। তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা ব্রহ্মসূত্রের উপর রচিত “শারীরিক ভাষ্য”। শঙ্কর ছিলেন অদ্বৈতবাদের সমর্থক। শঙ্কর তাঁর গুরুদেব গোবিন্দাচার্য এবং তাঁর গুরু গৌড়বাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অদ্বৈতবাদী দর্শনের ভিত্তিকে আরো সুদৃঢ় করেন। শঙ্করের দর্শনে ব্রহ্মবাদ এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে।
শঙ্কর যে অর্থে ব্রহ্মকে নির্গুণ বলে মনে করেন : শঙ্করের মতে, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ মিথ্যা ও জীব ব্রহ্মস্বরূপ। শঙ্কর কেবলাদ্বৈতবাদী। কারণ তিনি ব্রহ্মের সত্তা ছাড়া আর কোন কিছুর সত্তা স্বীকার করেন নি। ব্রহ্মের স্বরূপ বর্ণনা প্রসঙ্গে শঙ্কর বলেছেন, ব্রহ্ম নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ ও মুক্ত। ব্রহ্ম অসীম, অনন্ত ও নির্গুণ। ব্রহ্ম এবং আত্মার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আত্মাই ব্রহ্ম। শঙ্করের মতে, দুই প্রকার দৃষ্টিভঙ্গি হতে ব্রহ্মকে বর্ণনা করা যায়। যথা : ব্যবহারিক
দৃষ্টিভঙ্গি (Empirical point of view) ও পরমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি (Transcendental point of view)। ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো অজ্ঞানতা-প্রসূত, আর পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো জ্ঞান-প্রসূত। ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গিতে জগৎ সত্য এবং ব্রহ্মই এ জগতের সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা এবং সংহারক। এ দৃষ্টিতে ব্রহ্ম নানাবিধ গুণ সমন্বিত। তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও সর্বত্র বিরাজমান পুরুষ । এ গুণবান ব্রহ্মকেই শঙ্কর সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর আখ্যা দিয়েছেন। ব্যবহারিক দৃষ্টিতে ব্রহ্ম সগুণ হলেও পরমার্থিক দৃষ্টিতে তিনি নির্গুণ। শঙ্করের মতে, পরমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গিই সত্যিকারের দৃষ্টিভঙ্গি। পরমার্থিক দৃষ্টিতে ব্রহ্ম সত্য, জ্ঞানও অনন্ত। ব্রহ্ম জগতের স্রষ্টা, রক্ষক বা সংহারক কিছুই নন। তিনি নিরাকার ও নির্গুণ। শঙ্কর পরমার্থিক অর্থে ব্রহ্মকে নিৰ্গুণ বলে মনে করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যবহারিক দৃষ্টিতে ব্রহ্ম সগুণ অর্থাৎ তিনি নানাবিধ গুণ সমন্বিত। তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও সর্বত্র বিরাজমান পুরুষ। এ সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরেরই পূজার্চনা হয়। কিন্তু শঙ্করের মতে, ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি সত্যিকার দৃষ্টিভঙ্গি নয়। এটা অবভাসমাত্র। তাঁর মতে, পরমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গিই সত্যিকারের দৃষ্টিভঙ্গি। তবে সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের উপাসনার উপকারিতা শঙ্কর স্বীকার করেন। তাঁর মতে, ঈশ্বরের উপাসনার দ্বারা চিত্তশুদ্ধ হয় এবং চিত্তশুদ্ধি ব্যতিরেকে নির্গুণ ব্রহ্মের কোন ধারণাই হয় না।