শঙ্করের ব্রহ্মবাদ সংক্ষেপে আলোচনা কর ।

অথবা, শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মবাদ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, শঙ্করের ব্রহ্মবাদ সম্পর্কে লেখ।
অথবা, ব্রহ্ম সম্পর্কে শঙ্করের অভিমত কী?
অথবা, শঙ্করের মতে ব্রহ্ম কী?
উত্তর৷ ভূমিকা :
দক্ষিণ ভারতের কেবল প্রদেশে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে শঙ্করাচার্যের জন্ম। অনেকে মনে করেন তাঁর জীবনকাল ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দ হতে ৮২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তিনি বৃহদারণ্যক, ছান্দোগ্য প্রভৃতি প্রধান প্রধান উপনিষদ এবং ভগবদগীতার উপর ভাষ্য রচনা করেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে সর্বপ্রধান হলো বেদান্ত সূত্র বা ব্রহ্মসূত্রের উপর রচিত
‘শারীরিক ভাষ্য’। অদ্বৈতবাদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার মূলে শঙ্করের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। ব্রহ্মসূত্র এবং উপনিষদগুলোর যেসব ভাষ্য তিনি লিখেছেন তার উপর ভিত্তি করেই আমরা শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদের পরিচয় পাওয়া যায় শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মবাদ : ব্রহ্ম সম্পর্কে শঙ্করের মতামত নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ব্রহ্মস্বরূপ : শঙ্করের মতে, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ব্রহ্মস্বরূপ। শঙ্কর কেবলাদ্বৈতবাদী, কারণ তিনি ব্রহ্মের সত্তা ছাড়া আর কোনকিছুর সত্তা স্বীকার করেন নি। ব্রহ্মের স্বরূপ বর্ণনা প্রসঙ্গে শঙ্কর বলেছেন, ব্রহ্ম নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ ও মুক্ত। ব্রহ্ম অসীম, অনন্ত ও নির্গুণ। ব্রহ্ম এবং আত্মার মধ্যে
কোন পার্থক্য নেই। আত্মাই ব্রহ্ম।
২. ব্রহ্ম সৎ চিৎ ও আনন্দস্বরূপ : ব্রহ্ম সৎ অর্থ তিনি অসৎ নয়, ব্রহ্ম চিৎ অর্থ জড় নয় এবং ব্রহ্ম আনন্দ স্বরূপ অর্থ তিনি দুঃখস্বরূপ নয়।
৩. দুই প্রকার দৃষ্টিভঙ্গি : শঙ্করের মতে দুই প্রকার দৃষ্টিভঙ্গি হঁতে ব্রহ্মকে বর্ণনা করা যায় । যথা :
ক. ব্যবহারিক ও খ. পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি।
ক. ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি : ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো অজ্ঞানতা প্রসূত। এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে জগৎ সত্য এবং ব্রহ্মই এ জগতের সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা এবং সংহার। ব্রহ্ম সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও সর্বত্র বিরাজমান পুরুষ। এ গুণবান ব্রহ্মকেই এটি শঙ্কর সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু শঙ্করের মতে, যে জগৎ আমরা দেখেছি তা সত্যিকারের জগৎ নয়, অবভাস মাত্র। আমাদের অজ্ঞতার জন্যই এ জগৎকে আমরা সত্য বলে মনে করি এবং ব্রহ্মকে জগতের স্রষ্টা বলি । ব্রহ্মের এরূপ বর্ণনা তাঁর তটস্থ লক্ষণের বর্ণনা।
খ. পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি : পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো জ্ঞানপ্রসূত। এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে ব্রহ্ম জগতের স্রষ্টা, রক্ষক বা সংহারক কিছুই নয়; তিনি নিরাকার ও নির্গুণ। তাঁর কোন প্রকারভেদ নেই। ভেদ তিন প্রকারের। যথা : স্বজাতীয়, বিজাতীয় ও স্বগত। একই জাতীয় দুই জীবের মধ্যে যে ভেদ তাকে স্বজাতীয় ভেদ বলা হয়। যেমন- দুটি ঘোড়ার মধ্যে যে ভেদ, ভিন্ন জাতীয় দুটি জীবের মধ্যে যে ভেদ তাকে বিজাতীয় ভেদ বলা হয়। যেমন- একটি গরু ও একটি ছাগলের মধ্যে যে ভেদ। একই জীবের শরীরের বিভিন্ন অংশের যে ভেদ তাকে বলা হয় স্বগতভেদ। যেমন- একটি গরুর শরীরের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যে ভেদ। শঙ্করের মতে, এ তিন প্রকারের ভেদের কোন প্রকার ভেদ ব্রহ্মের নেই। ব্রহ্মের সদৃশ কোন বস্তু নেই বলে তাঁর স্বজাতীয় ভেদ চিন্তা করা যায় না; ব্রহ্মের অসদৃশ কোন বস্তু নেই বলে তাঁর বিজাতীয় ভেদ চিন্তা করা যায় না এবং ব্রহ্ম নিরবয়ব বলে তাঁর স্বগত ভেদও থাকতে পারে না। পারমার্থিক দৃষ্টিতে ব্রহ্ম সত্য, জ্ঞানও অনন্ত। এটি ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণ। শঙ্করের মতে, পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্রহ্মকে পরব্রহ্ম বলা হয় ।
৪. স্বরূপ লক্ষণ ও তটস্থ লক্ষণ : ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণ এবং তটস্থ লক্ষণ বুঝানোর জন্য শঙ্কর ব্রহ্মের সাথে জাদুকরের তুলনা করেছেন। জাদুকরের জাদুর খেলা দেখে অজ্ঞ ব্যক্ত িরা প্রতারিত হয় এবং জাদুকরকে জাদু স্রষ্টা মনে করে। কিন্তু বিজ্ঞ ব্যক্তিরা জাদুকরের চালাকি বুঝতে পারে বলে জাদুর খেলা দ্বারা প্রতারিত হন না এবং জাদুকরকে জাদু স্রষ্টা মনে করেন না। সেরূপ যারা জগৎকে সত্য বলে মনে করে, তারা ব্রহ্মকে জগৎ স্রষ্টারূপে জানে। কিন্তু যারা জগতকে অবভাস বলে জানে, তাদের কাছে সৃষ্টিও নেই স্রষ্টাও নেই। তারা ব্রহ্মকে জগৎ স্রষ্টা রূপে মনে করে না।
ব্রহ্ম বিশ্বগত ও বিশ্বাতীত : উপনিষদে ব্রহ্মকে বিশ্বগত ও বিশ্বাতীত বলা হয়েছে। শঙ্করও ব্রহ্মকে বিশ্বগত ও বিশ্বাতীত বলেছেন। শঙ্কর বলেছেন, যতক্ষণ জগৎ প্রপঞ্চ বিদ্যমান থাকে ততক্ষণ জগৎ ব্ৰহ্মেই অধিষ্ঠিত থাকে এবং ব্রহ্মও বিশ্বগত হন। আবার বিজ্ঞ ব্যক্তির নিকট জগৎ প্রপঞ্চ থাকে না এবং ব্রহ্ম স্বরূপে অধিষ্ঠিত হন। সুতরাং বিজ্ঞ ব্যক্তির চিন্তায় ব্রহ্ম বিশ্বাতীত ।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ব্রহ্ম সম্পর্কে শঙ্কর যে আলোচনা করেছেন তা ভারতীয় দর্শনের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।