অথবা, ব্রহ্ম সম্পর্কে রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, রামানুজ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের ব্রহ্ম সম্পর্কে কী বলেন?
অথবা, ব্রহ্ম সম্পর্কে রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মহর্ষি বাদরায়ন (আনু. ৫০০ খ্রি. পূ.) প্রণীত বেদান্তসূত্রে (৫৫৫টি সূত্র) ব্রহ্মতত্ত্ব প্রতিপাদিত হয়েছে বলে একে ব্রহ্মসূত্র বলে। আবার জীবের স্বরূপ বর্ণিত হওয়ায় একে শারীরিকসূত্রও বলা হয়। ব্রহ্মসূত্রের সাতটি ভাষ্যের মধ্যে শঙ্করের শঙ্করভাষ্য এবং রামানুজের শ্রীভাষ্য অন্যতম। শঙ্করাচার্য ও রামানুজ উভয়ে বাদরায়নকে অনুসরণ করে অদ্বৈতবাদ প্রচার করলেও শঙ্কারাচার্যের অদ্বৈতবাদ কেবলাদ্বৈতবাদ এবং রামানুজের অদ্বৈতবাদ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ নামে পরিচিত। রামানুজ বলেন, উপনিষদ্ এবং ব্রহ্মসূত্রের মূল বক্তব্য হলো ‘বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ’। রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ মতে, ব্রহ্মই পরম সত্য। তবে চিৎ এবং অচিৎ ব্রহ্মের দুটি অংশ। অচিৎ থেকে জগৎ এবং চিৎ থেকে চেতনা বা জীবের সৃষ্টি।
ব্রহ্ম সম্পর্কে রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ : ব্রহ্ম সম্পর্কে রামানুজ যে ধারণা পোষণ করতেন তা নিয়ে আলোচনা করা হলো-
১. ব্ৰহ্ম চিৎ ও অচিৎ বিশিষ্ট : রামানুজের মতে, ব্রহ্মের দুটি বিশিষ্ট অংশ চিৎ এবং অচিৎ অংশ ব্রহ্মের মতোই সত্য। চিৎ থেকে জীব এবং অচিৎ থেকে জগৎ আবির্ভূত হয়েছে। ব্রহ্ম যেমন সত্য, জীব ও জগৎও সেই পরিমাণে সত্য। জীব ও জগৎ ব্রহ্মের মতোই সমান সত্য হলেও তারা ব্রহ্মের অন্তর্গত এবং ব্রহ্মের বাইরে তাদের অস্তিত্ব নেই। কাজেই রামানুজের মতে, তত্ত্ব তিন প্রকার। যথা : ব্রহ্ম, চিৎ এবং অচিৎ।
২. ব্রহ্ম অসংখ্য সদগুণের অধিকারী : ব্রহ্ম সগুণ, নির্গুণ নন। রামানুজের মতে, গুণ ছাড়া দ্রব্য ছাড়া গুণ থাকতে পারে না। একমাত্র সগুণ দ্রব্যই আমাদের অনুভবের বিষয় হতে পারে। কাজেই নির্গুণ দ্রব্যের কোন সত্তা নেই। কেননা নির্গুণ দ্রব্য আমাদের অনুভবের বিষয় হতে পারে না। রামানুজের মতে, সৎ চিৎ আনন্দ হলো ব্রহ্মের গুণ। ‘সৎ’ অর্থে ব্ৰহ্ম
অস্তিত্ববান। ব্রহ্ম চিৎ অর্থ ব্রহ্ম স্বপ্রকাশ এবং ব্রহ্ম আনন্দ অর্থ ব্রহ্ম অনন্ত আনন্দের আঁধার। ব্রহ্ম নিত্য, অসীম, অনন্ত অপরিণামী ও সর্বপ্রকার দোষমুক্ত।
৩. ব্রহ্ম সবিশেষ : ব্রহ্মের স্বগতভেদ আছে বলে ব্রহ্মর নির্বিশেষ নয়, সবিশেষ। রামানুজের মতে, ব্রহ্ম থেকে সব বিশেষ নির্গত হচ্ছে । ব্রহ্ম সর্বপ্রকার বিশ্লেষণের আঁধার, তিনি নির্বিশেষ নন। পরন্তু বিশেষণযুক্ত। অতএব ব্রহ্ম সবিশেষ।
৪. ব্রহ্ম জগতের উপাদান ও নিমিত্ত কারণ : ব্রহ্ম জগতের উপাদান কারণ ও নিমিত্ত কারণ উভয়। ব্রহ্মের অন্তর্গত চিৎ গুণের সাহায্যে তিনি জীব এবং অচিৎ গুণের সাহায্যে জগৎ সৃষ্টি করেন। সৃষ্টির পূর্বে জীব চিৎ এবং জগৎ অচিৎরূপে ব্রহ্মে নিহিত থাকে। মাকড়সা যেমন নিজের দেহের ভিতর থেকে তন্ত্র বের করে জাল তৈরি করে ব্রহ্মও তেমন নিজের
ভিতরকার চিৎ ও অচিৎ অংশের অভ্যন্তরীণ শক্তির সাহায্যে এ জীবজগৎ সৃষ্টি করেছেন ।
৫. ব্রহ্ম জগতের ভিতরে ও বাইরে আছেন : ব্রহ্ম জগতের মধ্যে লীন হয়ে থাকলেও তিনি জগতের অতিবর্তীও। তিনি জীব জগতের উপাদান কারণ হিসেবে সংসারে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছেন। আত্মা যেমন দেহের অভ্যন্তরে থেকেও দেহকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্রহ্মও তেমন জগতের বাইরে থেকেও জগতকে নিয়ন্ত্রণ করেন।
৬. ব্রহ্ম পুরুষোত্তম : রামানুজের মতে, শঙ্করাচার্যের ব্রহ্ম পুরুষ নন, শূন্য গর্ভ মানসিক ধারণামাত্র। প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্ম সকল গুণামণ্ডিত পরিপূর্ণ সত্তা। জগতে আমরা যেসব শ্রেষ্ঠ গুণ মানুষের মধ্যে দেখি তারই বাধা-বন্ধনহীন পরিপূর্ণ প্রকাশ ব্রহ্মের মধ্যে। কাজেই ব্রহ্ম পুরুষোত্তম।
৭. বিষ্ণুই ব্রহ্ম বা ঈশ্বর : ঈশ্বর আ
র ব্রহ্মে কোন পার্থক্য নেই। রামানুজের মতে, ঈশ্বরই পারমার্থিক সত্য। ঈশ্বর বা ব্রহ্ম সচেতন পুরুষ। তিনি ভগবান, বাসুদেব, নারায়ণ বা বিষ্ণু।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের অপূর্ব সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। জীব মাত্রই ব্রহ্মকে সাক্ষাৎভাবে উপলব্ধি করতে পারে- এ কথা বলে তিনি সাধারণ মানুষের দর্শন চেতনার আকুতিকে পরিতৃপ্ত করেছেন। কাজেই ব্রহ্ম, জগৎ ও জীবের সম্পর্ক আলোচনায় রামানুজ যে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ প্রচার করেছেন তা ভারতীয় দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।