বৈশেষিক মতে সামান্য কী?

অথবা, সামান্য বলতে কী বুঝায়?
অথবা, বৈশেষিক মতে সামান্য বলতে কী বুঝ?
অথবা, বৈশেষিকদের অনুসারে সামান্যের সংজ্ঞা দাও।
অথবা, বৈশেষিকদের মতে সামান্য কাকে বলে?
উত্তর৷ ভূমিকা :
বৈশেষিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি কণাদ । মহর্ষি কণাদের প্রকৃত নাম উলুক । কণাদ ও উলুক—এই দুই নাম অনুসারে তাঁর প্রণীত দর্শন ‘কণাদ দৰ্শন’ বা ‘ঔলুক্য দর্শন’ নামে পরিচিত। এই দর্শনে ‘বিশেষ’ নামে একটি পদার্থ স্বীকার করায় এর নাম বৈশেষিক দর্শন হয়েছে। বৈশেষিক মতে, পদার্থ সাত প্রকারের এবং সব পদার্থই
জ্ঞানের বিষয় বা প্রমেয়। বৈশেষিক সাত প্রকারের পদার্থকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। যথা : ক. ভাবপদার্থ এবং খ. অভাবপদার্থ। সকল অস্তিত্বশীল বস্তু ভাবপদার্থ। যেমন- দ্রব্য, গুণ ইত্যাদি। বৈশেষিক স্বীকৃত সাতটি পদার্থের দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ এবং সমবায় এ ছয়টি ভাবপদার্থ।
সামান্য (Generality) : যে সাধারণ প্রকৃতির জন্য এক জাতীয় অনেক দ্রব্যকে একই নামে ডাকা হয় সে সাধারণ প্রকৃতিকে বলা হয় সামান্য। যেমন- রহিম, করিম, শফিক, আজাদ প্রমুখ বিভিন্ন মানুষের একটি সাধারণ প্রকৃতি আছে এবং সেটি হলো মনুষ্যত্ব। এই মনুষ্যত্বের জন্যই রহিম, করিম, শফিক, আজাদ প্রমুখ বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে অল্প বিস্তর পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাদের মানুষ বলে ডাকা হয়। কাজেই ‘মনুষ্যত্ব’ মানব জাতির সামান্য। পাশ্চাত্য দর্শনে যাকে সার্বিক (Universal) বলা হয়, ভারতীয় দর্শনের সামান্য তারই অনুরূপ। ন্যায় বৈশেষিক মতে, সামান্য এক জাতীয় দ্রব্যের নামও নয়, আবার তাদের সমান গুণের সমষ্টিও নয়। সামান্য এক জাতীয় দ্রব্যের নাম ও সমান গুণের সমষ্টির অতিরিক্ত একটি নিত্য পদার্থ। সামান্য একজাতীয় দ্রব্যের প্রত্যেকটির মধ্যে উপস্থিত থাকলেও তার দ্রব্য নিরপেক্ষ একটি সত্তা আছে। দ্রব্যের উৎপত্তি ও বিনাশ আছে, কিন্তু সামান্যের উৎপত্তি ও বিনাশও নেই । যেমন- প্রতিটি মানুষের জন্ম আছে, কিন্তু তার মনুষ্যত্ব অপরিবর্তিত থাকে। পাশ্চাত্য তর্ক ও দর্শনশাস্ত্রে এই মতবাদকে বাস্তববাদ (Realism) বলা হয়। ন্যায় বৈশেষিক মতে সামান্যের কোন সামান্য থাকে না। যেমন- মনুষ্যত্বের মনুষ্যত্ব থাকতে পারে না। কোন সামান্যের যদি সামান্য থাকে তবে তার আবার সামান্য থাকবে। এভাবে অনবস্থা দোষ (Fallacy of Infinite Regress) দেখা দেবে। আবার একজাতীয় দ্রব্যের একটি সামান্য থাকে। যেমন- মানুষ জাতির সামান্য কেবল মনুষ্যত্ব। একজাতীয় দ্রব্যের যদি একাধিক সামান্য থাকে তবে এই সামান্য বিপরীত বা বিরুদ্ধ প্রকৃতির হবে। ফলে শ্রেণিবিভাগ সম্ভব হবে না। যেমন- মানুষ জাতির সামান্য যদি মনুষ্যত্ব ও পাখিত্ব হয়, তবে মানুষের শ্রেণিবিভাগ সম্ভব নয়। কারণ তখন মানুষকে
মানুষও বলা যাবে আবার পাখিও বলা যাবে। ন্যায়-বৈশেষিক মতে, সামান্য দেশে ও কালে থাকে না, কেবল দ্রব্য, গুণ ও কর্মে থাকে । বৈশেষিক দর্শনের এই মত বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদী বহু আধুনিক পাশ্চাত্য দার্শনিকও স্বীকার করেছেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বৈশেষিকদের পদার্থ সম্পর্কীয় মতবাদে সামান্য সম্পর্কে যে আলোচনা করা হয়েছে তা দর্শনের আলোচনার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।