অথবা, এরিস্টটলের ন্যায় অনুমানের সাথে ন্যায়দর্শনের অনুমানের পার্থক্য দেখাও।
অথবা, ন্যায়দর্শনের অনুমানের সাথে এরিস্টটলের অনুমানের পার্থক্য তুলে ধর।
অথবা, নৈয়ায়িকদের অনুমানের সাথে এরিস্টটলের অনুমানের কী কী পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়?
উত্তর৷ ভূমিকা : ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন আস্তিক স্কুলসমূহের মধ্যে বস্তুবাদী দর্শন হিসেবে ন্যায়দর্শন স্বাধীন চিন্তা ও বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি গৌতম। ন্যায়দর্শনের মূলভিত্তি হলো ‘ন্যায়সূত্র’। ন্যায়দর্শন যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং বস্তুর জ্ঞান নিরপেক্ষ স্বাধীন সত্তায় বিশ্বাসী। ন্যায়দর্শনকে নামান্তরে তর্কশাস্ত্র, প্রমাণশাস্ত্র, হেতুবিদ্যা, বাদবিদ্যা এবং আন্বীক্ষিকী বিদ্যা বলা হয়। ন্যায়দর্শনের মূল ও প্রধান উপজীব্য বিষয় হলো জ্ঞানতত্ত্ব। নৈয়ায়িকরা জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনায় বলেছেন প্রমাণ চার প্রকার। যথা : প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শব্দ। নিম্নে অনুমান সম্পর্কে ন্যায় মতবাদ আলোচনা করা হলো :
এরিস্টটলীয় সহানুমানের সঙ্গে ন্যায়দর্শনের তুলনা : অনুমান শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো জ্ঞানের পশ্চাৎগামী জ্ঞান। অনু’ শব্দের অর্থ ‘পশ্চাৎ’ এবং ‘মান’ শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’। সাধারণ অর্থে অনুমান হলো সেই জ্ঞান যা অন্য জ্ঞানকে অনুসরণ করে। কোন একটি বিষয়কে প্রত্যক্ষ করে সেই প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতে অপর একটি অজ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার প্রক্রিয়াকে অনুমান বলে। এরিস্টটলীয় সহানুমানের সঙ্গে ন্যায়দর্শনের কিছু সাদৃশ্য, আবার কিছু বিষয়ে বৈসাদৃশ্য
পরিলক্ষিত হয়।
সাদৃশ্য :
১. উভয় প্রকার ন্যায়েই তিনটি পদের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। যথা : সাধ্য, পক্ষ ও হেতু।
২. উভয় ন্যায়েই হেতুর মাধ্যমে পক্ষের সাথে সাধ্যের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. উভয় ন্যায়েই সার্বিক সম্পর্ক বা ব্যাপ্তি জ্ঞানকে অনুমানের মূলভিত্তিরূপে গণ্য করা হয়।
৪. এরিস্টটলীয় সহানুমান তিন অবয়ব বিশিষ্ট, কোন কোন ক্ষেত্রে ন্যায়দর্শনের ন্যায়ও তিন অবয়ব বিশিষ্ট। তিন অবয়ব বিশিষ্ট ন্যায়ের সমর্থনকারী ন্যায়াচার্যগণ ন্যায়ে প্রতিজ্ঞা ও হেতু এ বচনের দু’বার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন মনে করেন।
৫. উভয় ন্যায়ে তর্কবাক্যের মধ্যে একটি সার্বিক বচন হবে- এ কথা স্বীকার করা হয়।
বৈসাদৃশ্য :
১. এরিস্টটলীয় সহানুমান সব সময় তিন অবয়ব বিশিষ্ট। কিন্তু ন্যায়দর্শনের ন্যায়ে পঞ্চ অবয়বের গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
২. তিন অবয়ব বিশিষ্ট ন্যায়দর্শনের ন্যায়ের অবয়বের ক্রম এরিস্টটলীয় সহানুমানের অবয়বের বিপরীত। নৈয়ায়িকগণ সিদ্ধান্তকে প্রথমেই ব্যক্ত করেন এবং হেতু ও সাধ্যের সার্বিক সম্পর্ককে সর্বশেষে ব্যক্ত করেন। অপরদিকে, এরিস্টটলীয় সহানুমানে হেতু ও সাধ্যের সার্বিক সম্পর্ককে প্রথমে ব্যক্ত করে এবং সিদ্ধান্ত সর্বশেষে ব্যক্ত করা হয়।
৩. এরিস্টটল সহানুমানের বিভিন্ন সংস্থান এবং বিভিন্ন মূর্তি স্বীকার করেন। কিন্তু নৈয়ায়িকগণ ন্যায়ের সংস্থান বা মূর্তির কোনটাকেই স্বীকার করেন নি।
৪. এরিস্টটলীয় সহানুমানের লক্ষ্য অনুমানের কেবল আকারগত সত্যতাকে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু ন্যায়দর্শনের ন্যায়ের লক্ষ্য অনুমানের আকারগত ও বস্তুগত উভয় প্রকার মতামতকে প্রতিষ্ঠা করা।
৫. এরিস্টটলীয় সহানুমানে অনুমানকে অবরোহ ও আরোহ – এ দুভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। কিন্তু নৈয়ায়িকগণ অবরোহ ও আরোহ -এ উভয় প্রকার অনুমানের সমন্বয়সাধন করেছেন।
৬. এরিস্টটলীয় সহানুমানে যে সার্বিক বা সামান্য বচন ব্যবহৃত হয় তা রূপগত। অপরদিকে, ন্যায়দর্শনের ন্যায়ে ‘উদাহরণ’ নামক যে সামান্য বচন ব্যবহৃত হয় তা হচ্ছে আরোহ প্রক্রিয়ালব্ধ অভিজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ন্যায়দর্শনের জ্ঞানতত্ত্বে অনুমান সম্পর্কে যে আলোচনা করা হয়েছে তা ভারতীয় দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মূলত ভারতীয় দর্শন যে বিচার বিযুক্ত নয় এবং অতিসূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণের উপর প্রতিষ্ঠিত ন্যায়দর্শনের অনুমান সম্পর্কিত আলোচনায় সে কথাই প্রমাণিত হয়।